বেসরকারি শিক্ষকদের সরকার বে-দরকারি মনে করে কী না, কে জানে? নইলে বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ে এতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনোভাব কেন? সরকার থেকে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিও’র মাধ্যমে যে আর্থিক সুবিধা পান, তা এক সময় ‘অনুদান’ নামেই অভিহিত ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের আন্দোলনে ‘অনুদান’ শব্দটি পরিহার করার দাবির প্রেক্ষিতে তা ১৯৯৪ সালে ‘বেতন-ভাতার সরকারি অংশ’ নামে অভিহিত হয়। সে ভাবেই তো চলে আসছে।
কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলের পৃথক গেজেটে আবার খটকা বাজিয়ে দেয়া হলো। তাতে আবার ‘বেতন ভাতার সরকারি অংশের’ পরিবর্তে ‘অনুদান-সহায়তা’ প্রতিস্থাপিত হলো। এ সব তালগোল পাকানোর হেতুটা কী? সম্পূর্ণ মীমাংসিত এ বিষয়টিকে নিয়ে আবার পেছনে ফেরা কেন?
‘বেতন ভাতার সরকারি অংশ’ আবার ‘অনুদান-সহায়তা’ হয় কী করে? এ কি ইচ্ছাকৃত নাকি অজ্ঞতা প্রসূত? ইচ্ছাকৃত যদি হয়ে থাকে, তবে তা মার্জনার যোগ্য নহে। ইচ্ছা করে কী বেসরকারি শিক্ষকদের তাচ্ছিল্য করা, নাকি সরকারের বিরুদ্ধে বেসরকারি শিক্ষকদের উসকে দেয়া? নাকি জেনে শুনে সরকারি সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা?
‘অনুদান’ হচ্ছে তা-ই, যা অনুগ্রহ কিংবা করুণা করে কাউকে দেয়া হয়। আর ‘বেতন’ হচ্ছে, কারো এমন একটি পাওনা বা প্রাপ্য অধিকার, যা তার শারীরিক ও মানসিক শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত। ‘অনুদান’ করুণা প্রসূত, কিন্তু ‘বেতন’ মানুষের ন্যায্য অধিকার। অনুদান যে কোন সময় বন্ধ করে দেয়া যায় কিংবা ইচ্ছা করলে কেউ তা নাও দিতে পারে, কিন্তু বেতন উপযুক্ত কারণ ব্যতিরেকে বন্ধ করা যায় না, তা দিতেই হয়।
বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীরা কারো অনুগ্রহের পাত্র নহেন যে, তারা দিনান্ত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে অনুদান গ্রহণ করবেন। তারা দায়িত্ব নিয়ে আত্ম-মর্যাদার সাথে কাজ করেন। জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং সর্বোপরি প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ধারণ করেন বলেই তারা ‘অনুদান’ নহে, ‘বেতন’ পেয়ে থাকেন। বিষয়টি বহু আগেই মীমাংসিত। এখন এ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের অবকাশ নেই। তাই কথিত গেজেটের সংশোধন প্রয়োজন।
বৈষম্যের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে দেশের কয়েক লক্ষ বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী। পদে পদে কেবলই বৈষম্য আর বৈষম্য। আজ এ রুপ একটি বিষয়ের অবতারণা করবো, যা একটি সামান্য বিষয় মনে হলেও তাতে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে ফুটে ওঠে।
সেটি ‘ইনক্রিমেন্ট’ বা ‘বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি’। সরকারি চাকরিজীবিরা প্রতি বছর নিজ স্কেলের উপর নির্ধারিত যে বর্ধিত টাকা পান, তাই ইনক্রিমেন্ট। তা প্রতি বছর তাদের স্কেলের সাথে যোগ হয়ে মূল বেতনে রুপান্তরিত হয় এবং এরই ভিত্তিতে তারা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য হন। প্রতি বছরই এ ইনক্রিমেন্ট যোগ হতে হতে এক সময় মূল বেতন প্রকৃত স্কেল ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যায় এবং এর ভিত্তিতে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাড়তে থাকে।
কিন্তু, বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের একটা ‘মৃত ইনক্রিমেন্ট’ আছে। এটা কিভাবে ইনক্রিমেন্ট-এর সংজ্ঞায় পড়ে, তা বোধগম্য নহে। এটি স্কেলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পুরাতন কোনো একটা স্কেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তারপর কতো বার স্কেল বদলেছে, কিন্তু ইনক্রিমেন্টটি যেই সেই থেকে গেলো। তা ছাড়া বছর শেষে তার তো কোন নড়চড় নেই। স্কেলের সাথে যোগ হয় না। কেবল সর্বমোটের সাথে যোগ থাকে। এমপিও-তে এটি ইনক্রিমেন্ট বলে চিহ্নিত। এটি আবার কোন জাতের ইনক্রিমেন্ট?
অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে ইনক্রিমেন্ট ব্যবস্থা বাদ দিয়ে বছরে ৫% হারে বেতন বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। এটি শুধু সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য নাকি অন্যদের জন্যও প্রযোজ্য হবে? বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে এতো দিন ইনক্রিমেন্টের নামে যে প্রহসন করা হয়েছে, অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে এসে ও কী তা-ই অব্যাহত থাকবে?
তাদের চাকরি জাতীয়করণের স্বার্থে এ বৈষম্যের অবসান হওয়া উচিত। একটা একটা করে বৈষম্য বিদায় করলে সরকারিকরণের বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে। আসলে তারা এখন সরকারি হয়ে যাবার অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে চলে এসেছেন।
লেখক: মুজম্মিল আলী
অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।