অবারিত শিক্ষার আহ্বান

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

'শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'-এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এক চমকপ্রদ ও সাড়া জাগানিয়া শ্লোগান । প্রকৃতপক্ষে এখন এমন একটা জায়গায় আমাদের পৃথিবী নামের গ্রহটা এসে উপনীত হয়েছে যখন শিক্ষা ছাড়া রাষ্ট্র তো বটে কোন ব্যক্তিরও এগিয়ে যাবার কিংবা টিকে থাকার কোনো উপায় নেই ।

সৃষ্টির লেই শিক্ষার তাগিদ । শিশু জন্ম নেবার পর থেকেই তার শেখার সুচনা । মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত শেখার মধ্য দিয়ে জীবনের অবসান । শিক্ষার মধ্যেই জীবনের স্বার্থকতা নিহিত । শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে কেউ বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনা। টিকে থাকার ইতিহাস ও কারো নেই। পৃথিবীতে যত মহামানব এসেছেন তারা সকলেই এই অমোঘ সত্যের বাণীটি নিত্যদিন প্রচার করে গেছেন । 

একমাত্র শিক্ষাই স্রষ্টা ও সৃষ্টির দুরত্ব ঘুচিয়ে উভয়কে একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে । সৃষ্টির ঘোর রহস্য তখন আপনা থেকে উন্মোচিত হয়ে যায় । স্রষ্টা ও তাই চান । তার সৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির সব রহস্য যেন ভেদ করে উঠতে পারে । কিন্তু আমরা মানুষ জাতি সেদিকে এতটুকু ভ্রুক্ষেপ না করে ভিন্ন চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি । ভুলে যাই স্রষ্টাকে। ভুলে যাই আপন অস্তিত্বকে । তখনই  পথভ্রষ্ট হয়ে যাই । পাপিষ্ট হয়ে উঠি । আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে আজকের লেখার সূত্রপাত করেছিলাম । স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় আমাদের লোকসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি ছিল । এখন আমাদের সতের কোটির মত মানুষ । দ্বিগুণের চে' বেশি । ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিন গুণ হবে । ২১-২২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে । এখন আমাদের চিন্তা করার সময় হয়েছে যে আমাদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কি সে অনুপাতে বেড়েছে ?  যদি এর উত্তর 'না সূচক' হয় তবে তা সত্যি দেশ ও জাতির জন্যে উদ্বেগের কারণ বটে । 'শিক্ষাই একমাত্র হাতিয়ার যা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে'-জনৈক মনীষীর এ কথাটিকে ধারণ করে পৃথিবীর বহু দেশ এখন পরিবর্তনের হাওয়ায় দোল খেয়ে খেয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ।

আর আমরা ? ভাবসাব দেখে মনে হয় যে আমাদের সে যাত্রা শুরুর এখনো  সময় হয়নি । আমাদের দেশ ও জাতি উভয়েরই পোড়া কপাল বলতে হয় । না হয় দুনিয়ায় আর কোন্ দেশ কিংবা জাতি এতগুলো বছর পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ থেকেছে ? দ্বিজাতি তত্ত্বের অদ্ভুত এক বেড়াজালে আটকে পড়ে চব্বিশ-পঁচিশটি বছর খোয়াতে হয়েছে ? এরপর গণতন্ত্রের আড়ালে আবডালে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের কষাঘাতে আমাদের কম জর্জরিত হতে হয়নি । এতে সবচে' ক্ষতির শিকার হয়েছে আমাদের শিক্ষা । তবু  এতগুলো বছর অতিবাহিত হবার পর ও আমাদের শিক্ষায় সুবাতাস বইতে এখন এত দেরি কেন ?                                            

স্বাধীনতা অর্জনের এতটি বছর পর আমাদের সরকার ক'টি নতুন স্কুল-কলেজ তৈরি করে দিয়েছে ? দেশের প্রায় সবগুলো স্কুল-কলেজ স্থানীয় কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ।  আস্তে আস্তে পর্যায়ক্রমে সরকার একটু একটু করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় বটে । কিন্তু সে সব মোটেও পর্যাপ্ত নয় । এখনো আমাদের দেশে বহু এলাকা আছে যেখানে কোনো স্কুল নেই । সরকার কিছুদিন পুর্বে স্কুলবিহীন গ্রামগুলোতে একটি করে প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল । জানিনে সে উদ্যোগটি এখন কোন পর্যায়ে ? সবগুলো স্কুল নির্মাণ শেষ হয়ে গেলে অবিলম্বে সেগুলো চালু করা দরকার । হাওর-বাওর এবংবিচ্ছিন্ন ও টুকরো টুকরো পাহাড়ি জনপদের শতভাগ শিশুদের লেখাপড়ার আওতায় আনা একান্ত অপরিহার্য । পাইকারি ভাবে সকলকে উপবৃত্তি না দিয়ে পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের বেশি করে দেয়া প্রয়োজন । ধনী পরিবারের শিশুদের উপবৃত্তি দেবার কোনো মানে হয় না । 

এখন আরো বেশি বেশি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা খুব দরকারি হয়ে উঠেছে । প্রতি গ্রামে তো একটি বটে বড় বড় গ্রামগুলোতে একাধিক প্রাইমারি স্কুল বসানো দরকার । দ্রুত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাতটি ছোট সংখ্যায় নামিয়ে আনা প্রয়োজন । একেকটা শ্রেণিতে একজন শিক্ষকের জন্যে পঁচিশ-তিরিশ জনের বেশি শিক্ষার্থী মোটেও কাম্য হতে পারে না । 

সে হিসেবে দেশে স্কুল-কলেজ ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো দরকার । প্রতিটি ইউনিয়নে একাধিক হাই স্কুল ও অন্ততঃ একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার । প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার উপর জোর দেয়া একান্ত আবশ্যক । প্রতি ইউনিয়নে একটি কারিগরি স্কুল এবং প্রতি উপজেলায় একটি করে কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে । আইসিটি ও কারিগরি বিষয়ে যুবক যুবতিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পর্যাপ্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে ।

সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি সব স্কুল-কলেজে আইসিটি ও কারিগরি শাখা সংযুক্ত করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে উঠেছে । একটা বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করা প্রয়োজন । আর সেটি হলো 'পরীক্ষা'র চেয়ে 'পড়াশুনা'র ওপর আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে । পরীক্ষার রেজাল্টের চেয়ে পড়াশুনার মানের উপর বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন । আমাদের এখন এমন হয়েছে যে সন্তান পড়াশুনা করুক আর না-ই করুক পরীক্ষায় ভালো ফল চাই-ই চাই । এ মানসিকতা নিয়ে আর বেশি দিন টিকে থাকা উচিত হবে না । অবিলম্বে আমাদের সকলের এ মানসিকতা পরিহার করা দরকার  । 'পরীক্ষা' নামের ডিঙি নয় , 'লেখাপড়া' নামের জাহাজটি আজ আমাদের মজবুত করে তৈরি করা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে । 

  লেখক : অধ্যক্ষ , চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ , কানাইঘাট , সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক। । 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029041767120361