কাইয়ুমের ঘোড়া ও শিক্ষক শরীফুল

আহসান কবির |
দেশের নামকরা এক অর্থনীতিবিদের কাছে এসেছে এক কিশোর। এসে দেখলো অর্থনীতিবিদের কাছে এক সাংবাদিক জানতে চাইছে, চা আর কফির দাম এক হলে দেশের লাভ না ক্ষতি? অর্থনীতিবিদ তাঁর বিশ্লেষণ শুরু করলেন। ঘন্টাখানেক পরেও বিশ্লেষণ শেষ হলো না। কিশোরের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। সে বিশ্লেষণের মাঝখানে ঢুকে বললো, চা আর কফির আলোচনা বাদ। আমারে বুঝান গরু আর ঘোড়া দুইটাই ঘাস খায়। অথচ গরুরটা ছোট কিন্তু ঘোড়ার ঐটা এতো বড় কেন? অর্থনীতিবিদ রেগে গিয়ে বললেন, চুপ করো। ছোট মুখে খারাপ কথা। ঘোড়ারটা বড় কেন আমি জানি না। কিশোর চলে আসার আগে বললো, আপনি আসলে অর্থনীতি সম্পর্কেই কিছু জানেন না!

যারা কিছুই জানে না তারা নাকি বড় হয়ে মন্ত্রী হন, এমন গল্পও ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে আসছি।  অর্থনীতিবিদরা নিজ দেশের অর্থনীতি কতোটা বোঝেন সেটা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু আজকের লেখার প্রসঙ্গ অর্থনীতি নয়, ঘোড়া!

স্কুলে ইতিহাসের স্যার একদিন বলেছিলেন, ‘তরবারি হচ্ছে ঐতিহাসিক অস্ত্র আর ঘোড়া হচ্ছে ঐতিহাসিক টগবগে বেগবান প্রাণী! আগেরকালে ঘোড়া, তরবারি, তীর আর বর্শা দিয়ে রাজারা অন্যরাজ্য দখল করতেন’। যে রাজার কুমার রাজ্যের সুন্দরীতম রাজকন্যাকে নিয়ে ছুটে যেত সেই রাজকুমারের টগবগে ঘোড়া থাকত। রাজকুমার আর রাজকুমারী যখন স্বপ্ন দেখতো তখন তাঁরা পঙ্খীরাজে চড়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেত। পঙ্খীরাজ আসলে পাখাওয়ালা ঘোড়া। গ্রীক মিথে পঙ্খীরাজের দেখা মেলে। একালের পঙ্খীরাজ দেখা যায় শুধু চলচ্চিত্রে!
 
দিল্লীর সিংহাসন হারিয়ে সম্রাট হুমায়ুন একবার মহাবিপদে পরেছিলেন। পালানোর সময়ে ঘোড়া নিয়ে নদীতে লাফ দিতে হয়েছিল। তাঁকে প্রাণে বাচিয়েছিল নিজাম নামের এক ভিস্তিওয়ালা (পানি সরবরাহকারী)। হুমায়ুন বলেছিলেন যদি কোনোদিন সিংহাসন ফিরে পান তাহলে একদিনের জন্য হলেও নিজামকে সম্রাট বানাবেন। হুমায়ুন কথা রেখেছিলেন। কিন্তু একদিনের সম্রাট হয়ে নিজাম ভিস্তিওযালা সন্ধ্যার পর হেরেমে (যেখানে সম্রাটদের মনোরঞ্জনের জন্য আকর্ষণীয় রমনীরা থাকতো) যাবার আগ্রহ বেশি প্রকাশ করেছিলেন। হুমায়ুন অবশ্য নিজাম সাহেবের সে আশা পূর্ণ করেননি। সে যাই হোক, হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে আর সিংহাসন হারান ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বনে-বাদাড়ে ঘুরেছেন, পারস্য সম্রাটের আশ্রয়ে থেকেছেন। ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লীর সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। মাঝখানের দিনগুলোতে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি মাঝে মাঝেই বিপদে পড়তেন, ঠিকমতো সৈন্যদের জন্য খাবার যোগাড় করাও সম্ভব হতো না। তখন হুমায়ুন নিজ ঘোড়াবহরের এক দুইটা ঘোড়া জবাই দিতে বাধ্য হতেন!
 
বর্তমান সময়টা হুমায়ুন বাদশার যুগ না। তাই ঘোড়া জবাই দিয়ে দুইজন বিপদে পড়েছেন। বলা যেতে পারে তারা ‘বিরল এলাকায় একটি বিরল কাজ’ করেছেন। খবরে প্রকাশ হয়, দিনাজপুরের বিরলে কাজী পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম ও কাঠব্যবসায়ী কাইয়ুম আলী ঘোড়া জবাই করে ২০০টাকা কেজি দরে প্রায় দেড়মণ মাংস বিক্রি করেন। এটা নিয়ে এলাকায় তোলপাড় হলে কাজীপাড়া জামে মসজিদের সভাপতি লোকমান হাকিম থানায় অভিযোগ করেন। লোকমান হাকিমের অভিযোগ, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এলাকার মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। ভ্রাম্যমান আদালত শফিকুল ইসলাম ও কাইয়ুম আলীকে ছয়মাসের কারাদণ্ড দেয় এবং কাইয়ুম আলীর ভাই রায়হান আলীকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। এরপর বিরলে ঘোড়ার মাংস খাওয়া প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ এক দুই দিন নাকি পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন!
 
মজার ব্যাপার হচ্ছে স্পেনে গরুর মাংসের নামে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করার অপরাধে ৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। শুধু স্পেন নয় ইটালি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া ও সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের আটটি দেশে ঘোড়ার মাংস বিক্রি করা এই চক্রকে পুলিশ শনাক্ত করে প্রচলিত আইনে শাস্তি দেয়। ঘোড়ার মাংস ফ্রান্স ও ইটালিতে বিক্রি হয় তবে গরুর মাংসের তুলনায় এটা খুবই কম। কথায় আছ, গরু খাওয়ার আর ঘোড়া চড়ার! আফ্রিকার অল্প কয়েকটি দেশের কিছু গোত্রের মানুষ ঘোড়া ও হাতির মাংস খায়। তবে, ঘোড়ার মাংস খাবার প্রবণতা মানুষের ভেতরে খুবই কম দেখা গেছে। রেড মিটের ভেতর ঘোড়ার মাংস খানিক উত্তেজক, রক্ত আর হৃদপিন্ডের জন্য এই মাংস ভালো নয় বলে হয়তো ঘোড়ার মাংসের প্রতি মানুষের আসক্তি কখনো বাড়েনি।
 
তবে রূপকথার ঘোড়া কিংবা ঐতিহাসিক ঘোড়ার মতো একালের ঘোড়া কখনো ডাইনোসরের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় হবে না। ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা যেমন পৃথিবীর অনেক দেশে (বাংলাদেশেও হতো) হয়ে থাকে ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলা ‘পোলো’ এখন আর তেমন দেখা যায় না। একদা বাংলাদেশের অনেক এলাকার মানুষ ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা করতো, একদা এই ঢাকা শহর ঘোড়ার গাড়িতে ভরপুর ছিল। এখনো কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি ঢাকাতে চোখে পড়ে। এখনও অনেক জায়গায় বিয়ের বরযাত্রায় ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার দেখা যায়। কাউবয় বা ওয়েস্টার্ন ছবিতে ঘোড়ার বহর কিংবা রেসের ব্যবহার লক্ষণীয়। বাংলা ছবির জনপ্রিয় একটা গান হচ্ছে, ‘ধীরে ধীরে চল ঘোড়া, সাথী বড় আনকোরা!’ আল মাহমুদ তাঁর লেখা ‘সোনালী কাবিন’ দিয়ে বাংলা কবিতার যে ধারা তৈরি করেছিলেন তিনি নিজেই আবার সেটা বদলে ফেলেছিলেন নিজের লেখা আরেকটা বইয়ের মাধ্যমে। সেই বইয়ের নাম ছিল ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’! বখতিয়ারের ঘোড়া আগ্রাসী ঘোড়া। এই ঘোড়া অন্যের রাজ্য দখলে উম্মত্ত করে, পৃথিবীর এক সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং মানবিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’র বই পুড়িয়ে দিতে, বিশ্ববিদ্যালয় গুড়িয়ে দিতে প্রলুব্ধ করে! সেই তুলনায় শরীফুল ও কাইয়ুমের ঘোড়া হচ্ছে অসহায় ঘোড়া!
 
ঘোড়া নিয়ে অনেক কৌতুক আছে। একটা বলে বিদায় নেই। প্রিয় পাঠক, জনপ্রিয় কৌতুকগুলো একটু কেমন যেন হয়। তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বনের ভেতর ধর্ষণ বেড়ে গেল। সিংহ রাজা প্রমাদ গুনলেন। তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকলো। তিনি আইন করে সব পশুর ‘যন্ত্র’ জমা দিতে বললেন। যেই কথা সেই কাজ। সবাই নিজ নিজ ‘যন্ত্র’ জমা দিয়ে জমার স্লিপ নিয়ে বাড়ি ফিরতে লাগলো। সবার মন খারাপ হয়ে গেল শুধু লাফাতে লাগলো এক বানর। সবাই জানতে চাইলো, ‘ঐ বানর লাফাস কেন? এত খুশি লাগছে কেন তোর’। বানর বললো, ‘জমা দিছি নিজের যন্ত্র আর স্লিপ নিছি ঘোড়ারটার!’
 
লেখক: আহসান কবির, অভিনেতা ও রম্যলেখক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002993106842041