ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ডাকসু নির্বাচন হবে, সত্যিই?

জোবাইদা নাসরীন |

সবার চোখ, কান এখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে। কবে হবে, কী হবে? কী প্রক্রিয়ায় হবে? হিসাব-নিকাশ চলছে জোর কদমে। এর মধ্যেই আবার চলে এসেছে ডাকসু নির্বাচন প্রসঙ্গ। হাইকোর্ট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। চার সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষাসচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টরকে ওই রুলের জবাব দেওয়ার জন্য বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকেও ডাকসু নির্বাচনের জোরালো দাবি উঠেছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি গত বছরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। ডাকসু নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।’

তারপর পেরিয়ে গেছে ১৮ মাস। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বদল, প্রশাসনও কিছুটা বদলেছে, শিক্ষকেরা একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছেন। নিয়মিতভাবেই হচ্ছে শিক্ষক সমিতি নির্বাচন, ডিন, সিন্ডিকেটসহ সব নির্বাচন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নেই।

তবে গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী নীল দলের শিক্ষকদের বিভক্তি এবং রিটের পর বাম সংগঠন ডাকসু নিয়ে কিছুদিন মাঠে ছিল। শিক্ষকদের মধ্যে খুব কমই আলোচিত ছিল ডাকসুর ভাবনা। অথচ এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু হচ্ছে না ডাকসু।

এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকসু নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ডাকসু নির্বাচন ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এই আদেশ বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়। এ ছাড়া ডাকসু নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু ওই নির্দেশনা অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় আদালত অবমাননার নোটিশ পাঠানো হয়। এর আগে ডাকসু নির্বাচনে পদক্ষেপ নিতে ৩১ শিক্ষার্থীর পক্ষে ২০১২ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর ও ট্রেজারারকে লিগ্যাল নোটিশ দেন অাইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই নোটিশের কোনো জবাব না দেওয়ায় ওই বছরই ২৫ শিক্ষার্থীর পক্ষে রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সালের পর আর ডাকসু নির্বাচন হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন আইন অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে। তাই যথাসময়ে নির্বাচন করার নির্দেশনা চাওয়া হয় এই রিট আবেদনে।

এতে আরও বলা হয়, ১৯৯৮ সালের ২৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আজাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ডাকসু নির্বাচনের পর এর সময়সীমা হবে এক বছর। পরবর্তী তিন মাস নির্বাচন না হলে বিদ্যমান কমিটি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এ সিদ্ধান্তের পর ডাকসু ভেঙে দেওয়া হয়। ডাকসু বিধান অনুযায়ী প্রতিবছর নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। প্রায় ২২ বছর আগে ১৯৯০ সালের ৬ জুলাই ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ডাকসু নির্বাচনের কথা এলেই প্রথমেই যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয় তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হবে।

তবে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত আশার কথা যে আগামী বছরের মার্চে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তারই ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে প্রভোস্ট মিটিংয়ে হল প্রাধ্যক্ষদের নিজ নিজ হলের শিক্ষার্থীদের ডেটা হালনাগাদ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে কাজও শুরু হয়েছে হলগুলোতে। এই কাজের প্রথম অংশ হিসেবে বহিরাগত কেউ হলে অবস্থান করছে কি না, সেটি আগে দেখা হচ্ছে। অন্তত এটি ছাত্রী হলগুলোতে শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরাও ডাকসু নির্বাচন বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবে মজার বিষয় হলো, ডাকসু নিয়ে কোনো পক্ষই কখনো দ্বিমত পোষণ করেনি এবং সবাই সব সময় আশাবাদী ছিলেন এবং আছেন। তবু হয়নি ডাকসু। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারছেন না কেউই। এর পেছনে কারণও রয়েছ।

বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই কয়েক ধরনের নির্বাচন হয়, সিটি করপোরেশন, পৌর মেয়র নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং প্রতি পাঁচ বছর পরপর হয় জাতীয় নির্বাচন। এর বাইরেও বিভিন্ন কারণে অনেক আসনেই হয় উপনির্বাচন। সবাই এতগুলো নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে। সেই সব নির্বাচনেও সহিংসতার ভয় থাকে, সহিংসতা হয় কিন্তু নির্বাচন বন্ধ থাকে তা নয়। তাহলে শুধু ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখা হচ্ছে?

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত মাত্র সাতবার অনুষ্ঠিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচন, অথচ প্রতিবছরই এই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। ১৯৯০ সালের নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালের ১৮ জুন নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময় সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিঞা নির্বাচন বন্ধ করে দেন। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে পরপর দুবার উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ ডাকসুর তফসিল ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তখন বিরোধী দল হিসেবে ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে হয়নি ডাকসু নির্বাচন। ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কারণে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও হয়নি ছাত্র সংসদ নির্বাচন। অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী উপাচার্য হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের সময়সীমার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই বহুল কাঙ্ক্ষিত ডাকসু নির্বাচন আর হয়নি।

গত কয়েক বছরে কয়েকটি ছাত্র আন্দোলন ডাকসুর প্রয়োজন আমাদের ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থী-শিক্ষক-প্রশাসনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব যে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়, তা সব সময়ই অনুভব করি। তাই যেকোনো মূল্যে ডাকসু নির্বাচন হতে হবেই। প্রশাসনকেও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে সবার মাঝে এই মর্মে যে এবার সত্যিই ডাকসু নির্বাচন হবে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক

সূত্র: প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027470588684082