প্রশ্নপত্র সুরক্ষার সুপারিশ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড. মো. নাছিম আখতার |

NASIM AKTHARজাতি গঠনের চালিকাশক্তি হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণা। বাংলাদেশ যখন তথ্যপ্রযুক্তি ও উন্নয়নের ধারায় নিজেকে একাত্ম করেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করতে একটি কুচক্রী মহল কাজ করে চলেছে। আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর আলোকিত দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের আগামী দিনের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করেছে। এই তো সেদিন তিনি গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান চ্যাম্পিয়নস অব দি আর্থ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আইসিটি টেকসই উন্নয়ন পুরস্কার অর্জন করে সমগ্র জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। জাতি হিসেবে এটি আমাদের অহংকার ও অর্জনের এক অনন্যদৃষ্টান্ত। কিন্তু সব অর্জনের আলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের করালগ্রাসে। বিশেষ করে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সরকার ও জাতিকে বিব্রত হতে হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, কোনো এক কুচক্রী মহল সরকারের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রয়াস করছে, অথবা সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুবিধাভোগী কিছু মানুষ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আবার কখনো চিলে কান নিয়ে গেল এ ধরনের গুজবও ছড়ানো হচ্ছে। এর ফলে কী ঘটছে? আমাদের কোমলমতি মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। প্রকৃত মেধাবীদের আজীবনের লালিত স্বপ্ন বিলীন করে জায়গা করে নিচ্ছে মেধাশূন্য সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী। হতে পারে এটা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার দেশি ও বিদেশি কোনো অদৃশ্য ষড়যন্ত্র। কাজেই বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করে আমার মনে হয়েছে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমার একটি নিজস্ব প্রস্তাবনা আশা করছি সব আলোকিত মানুষকে চিন্তার খোরাক জোগাবে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের নিত্যদিনের বিব্রতকর ঘটনা এড়াতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে—

কোনো একটি বিষয়ের ১০ সেট প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে, যা করা হবে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে। প্রশ্নপত্র তৈরি করার পর সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে প্রতিটি কেন্দ্রে প্রেরণ করতে হবে। প্রশ্নপত্র তৈরি ও প্রেরণ করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এই সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কোনো ব্যত্যয় ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের বিষয়টিও সুস্পষ্ট হতে হবে। তবে আশার বিষয় এই যে এত সতর্কতা ও গোপনীয়তার পরও যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়, তবে সব সেট প্রশ্নপত্র একই সঙ্গে ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যেতে পারে। বিষয়টি এ রকম—কোনো একটি বিষয়ের সব সেট প্রশ্নপত্র একই সময়ে প্রেরণ না করে বিভিন্ন সময়ে প্রেরণ করতে হবে। তবে অবশ্যই তা ওই বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই কেন্দ্রে পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। যদি আমরা গাণিতিক বিষয়টি বিবেচনায় আনি, তাহলে বর্তমানে প্রচলিত ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন ফাঁস হলেই প্রশ্নের শতভাগ ফাঁসের আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ১০ সেট প্রশ্ন হলে সে ক্ষেত্রে এটি কমে দাঁড়াবে প্রায় শূন্যের কোঠায়। কারণ পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত কেউ জানবে না যে কোন সেটটিতে পরীক্ষা হবে।

পরীক্ষার আগের মুহূর্তে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়সহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ববান কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির সামনে লটারির মাধ্যমে ১ থেকে ১০ সংখ্যার মধ্যে যে সংখ্যাটি উঠবে সেই সংখ্যাটি বিটিভি, বেতার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোতে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ওই সেটটিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। লটারির ক্ষেত্রে মানুষের ওপর নির্ভরতা কমাতে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এই ডিজিটাল পদ্ধতিটি হবে প্রোগ্রামনির্ভর। অর্থাত্ প্রোগ্রামের মাধ্যমে জধহফড়স বা দৈবাত্ সিলেকশনের ভিত্তিতে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটি নির্ধারণ করতে হবে।

এত সব বিচার-বিশ্লেষণের পরও যদি প্রশ্নপত্র বহু নির্বাচনী হয়, তবে পরীক্ষার হলে অথবা কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণের শিথিলতার সুযোগে প্রকৃত মেধাবী প্রার্থী বাছাইয়ের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। যদি উপমা হিসেবে স্মার্টফোনের ব্যাপক ব্যবহার উল্লেখ করা যায়, তবে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। কেননা একটি স্মার্টফোন অবুঝ শিশু থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সব ধরনের মানুষ অতিসহজে ব্যবহার করতে পারে। কেননা এখানে কোনো কমান্ড বা নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আঙুলের স্পর্শই যথেষ্ট, যেখানে বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি গৌণ। অনুরূপ দৃষ্টান্ত টেনে বলা যায়, বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্রে যদি সামান্য আলোচনা অথবা দৃষ্টি প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়, তবে সে ক্ষেত্রে একজন মেধাশূন্য মানুষও তার অগোচরে সঠিক উত্তর নির্বাচন করতে সক্ষম হবে। যুগের চাহিদার সঙ্গে বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্রের যথার্থতা থাকলেও এ ক্ষেত্রে সত্, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি পরিবেশ তৈরি করা দুষ্কর। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, যদি প্রকৃত মেধাবীদের পরীক্ষা পদ্ধতির অস্বচ্ছতার কারণে নির্বাচন করা সম্ভব হয়ে না ওঠে, তবে জ্ঞাননির্ভর জাতি ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। বিষয়টি গুজবও হতে পারে অথবা সত্যও হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি কখনো গুরুতরভাবে প্রকট হয়ে ওঠেনি। এখানে কারণ হিসেবে বলা যায়, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় শতভাগ বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র থাকলেও অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃজনশীল সংক্ষিপ্ত ধরনের বর্ণনামূলক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীর প্রকাশভঙ্গি, বানানের নির্ভুলতা, বাক্যের গঠন, প্রকৃত বুদ্ধিমত্তাসহ তাদের মানসিকতা প্রকাশ পায়।

আমরা আশা করছি, আগামী দিনের আমাদের যে অবারিত সম্ভাবনার দ্বার তৈরি হয়েছে তা কেবল বিকশিত হতে পারে প্রকৃত মেধাবীদের যাচাইয়ের মাধ্যমে। এ রকম একটি মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আমরা আছি, যা শ্রাবণের বৃষ্টির মতো সব অন্ধকার ধুয়েমুছে প্রকৃত আলোর আভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। সেই আলোকিত বৃষ্টির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে সমগ্র জাতি।

লেখক : ড. মো. নাছিম আখতার

ডিন, তড়িত্ ও ইলেকট্রনিক কৌশল অনুষদ ও বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047781467437744