শিক্ষক বিদ্বেষীরাই বিতর্কিত করছে শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের ভাবমূর্তি

মো. রহমত উল্লাহ্‌ |

শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন সাধনে আন্তরিকতার পরিষ্কার স্বাক্ষর রাখার পরও বারবার বিতর্কিত হচ্ছে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি।

বেশি পেছনে না গিয়ে অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার কথাই বলছি আজকের এই লেখায়। যেমন- সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনোরকম পূর্বালোচনা না করে এবং বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই চলতি বাজেট প্রণয়নের সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো ভ্যাট। এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এল হাজার হাজার শিক্ষার্থী।

যারা কোনোদিন জানত না আন্দোলন কাকে বলে, কীভাবে করতে হয়; তারা শিখে গেল সফল আন্দোলন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা অচল করে দিল সারা ঢাকা শহর। তাদের পক্ষে সমর্থন দিল অনেকেই। এই আন্দোলন দানা বাঁধার সময় অর্থমন্ত্রী শক্ত শক্ত কথা বলার কারণে আরো চাঙ্গা হলো তা এবং সরকার বাধ্য হলো সেই ভ্যাট প্রত্যাহার করতে।

দীর্ঘদিন পরে কোনো একটি ডেকে আনা আন্দোলনের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো শেখ হাসিনা সরকারকে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে কি উদ্দেশ্য ছিল অহেতুক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মানুষের কাছে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার? আবার তিনি বলে দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব।

এ নিয়ে শুরু হলো সমালোচনা ও প্রতিবাদ। সেই সঙ্গে সমালোচিত হলো বর্তমান সরকার। শেষে কিছু ব্যাখ্যা ও দুঃখ প্রকাশ করলেন তিনি।

জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর শুরু থেকে এখনো থেমে নেই বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসরদের পদমর্যাদা ও বেতন গ্রেড নির্ধারণ করা হলো সচিবদের নিচে। শুরু হলো তাদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন। তৈরি হলো অশান্তি। বিঘ্নিত হলো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া। বিতর্কিত হলো সরকার।

শিক্ষামন্ত্রী অনেক দরবার করে, অনেক অনুরোধ করে, অনেক কৌশল করে নানান কথা বলে থামালেন সেই শিক্ষকদের। তারপর মানা হলো তাদের দাবি, কিন্তু সেখানেও রাখা হলো বিতর্কের সুযোগ। জাতীয় অধ্যাপকদের দেয়া হলো না যথাযথ মর্যাদা।

এদিকে জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর প্রথম কপিতে ব্লুক করে দেয়া হলো সরকারি কলেজের শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ধাপে যাওয়ার রাস্তা। শিক্ষকরা হারাতে বসলেন মাউশি সহশিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের প্রধান হওয়ার যোগ্যতা।

এমনকি সরকারি কলেজের প্রফেসররা হারাতে বসলেন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে বসার যোগ্য পদোন্নতি পাওয়ার উপায়। শুরু হলো প্রতিবাদের ঝড়। আসতে শুরু করল আন্দোলনের বিভিন্ন হুমকি ও কর্মসূচি। যেমন- সাধারণত সরকারি কলেজের অধ্যাপকরা চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা। কিন্তু সিলেকশন গ্রেড থাকায় এতদিন মোট অধ্যাপকদের মধ্যে ৫০ শতাংশ অধ্যাপক গ্রেড-৩-এ যেতে পারতেন। কিন্তু সিলেকশন গ্রেড বাদ দেয়ায় এখন এই পথ বন্ধ হয়ে গেল।

১৫ ডিসেম্বর বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপনে এ বিষয় সুরাহা না হওয়ায় আবারো আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। [দৈনিক শিক্ষা ডট কম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৫] এতে কমবেশি বিনষ্ট হবে লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ। সমালোচিত হচ্ছে সরকার। অবশেষে হয়তো আরো আশ্বস্ত করা হবে এবং যুক্তিযুক্ত হলে দাবিও মেনে নেয়া হবে তাদের। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে- হবে বারবার?

অন্যদিকে এই পে-স্কেলের প্যাঁচকলে বারবার আটকে দেয়া হলো এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন। অতীতে শেখ হাসিনা সরকার যতবার জাতীয় বেতন স্কেল দিয়েছে, ততবারই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই স্কেল পেয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা।

সে মতে সবারই ধারণা ছিল এবারের বর্ধিত বেতন স্কেলেও আগের মতোই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অন্তর্ভুক্ত হবেন তারা। কিন্তু নতুন স্কেলে প্রথমে অস্পষ্ট রাখা হলো তাদের বেতনভাতা বর্ধিত করার কথা। বিক্ষুব্ধ হলেন, বিবৃতি দিলেন, সভা করলেন, কর্মসূচি দিলেন বেসরকারি শিক্ষক সমাজ; যারা এই দেশের মোট শিক্ষকের প্রায় নব্বই শতাংশ। এরপর জুড়ে দেয়া হলো আরেক শর্ত। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে অর্জিত আয় সরকারকে জমা দিয়ে তারপর নিতে হবে বর্ধিত হারে সরকারি অংশের বেতনভাতা।

আবার ক্ষুব্ধ হলেন দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। তাদের অধিকাংশই যুক্তিযুক্তভাবে বললেন, তাদের চাকরি জাতীয়করণ করে তারপর নিয়ে নেয়া হোক প্রতিষ্ঠানের আয়। তা না হলে শর্তহীনভাবে দিয়ে দেয়া হোক বর্ধিত স্কেলের মূল বেতন। কেননা কেবল শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতন দিয়ে পূর্ণ ভাতাদি, ইনক্রিমেন্ট, বোনাস ও পদোন্নতি এবং পর্যাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষক না দিয়ে প্রতিষ্ঠানের সব আয় নিয়ে নিলে প্রতিষ্ঠান চলতে পারবে না। লেখালেখি হলো পত্রপত্রিকায়। সমালোচনা হলো সর্বত্র। অসন্তোষ দেখা দিল শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। তারপর গত ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এল এক প্রজ্ঞাপন। যাতে লেখা হলো ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করিয়া তাহাদের যোগ্যতা ভিত্তিক অনুদান-সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ কর্তৃক মূল্যায়নক্রমে প্রাপ্য অনুদান-সহায়তা নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়নের তারিখ অর্থাৎ ০১ জুলাই ২০১৫ তারিখ হইতে কার্যকর করা সমীচীন হইবে।

২। এমতাবস্থায় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুদান-সহায়তা নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়নের তারিখ অর্থাৎ ০১ জুলাই ২০১৫ হইতে কার্যকর হবে।’ এটিতেও রাখা হলো অনেক মারপ্যাঁচ। কি যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা কখন থেকে পাবেন এই বর্ধিত সুবিধা আর কি অযোগ্যতার কারণে কারা বঞ্চিত হবেন? অর্থাৎ শর্তহীনভাবে নতুন স্কেলে সবার সঙ্গে বেতন পাবেন কি না, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি এই সার্কুলারে। এতে যে কিছু মারপ্যাঁচ আছে এটির আরো প্রমাণ হচ্ছে- ডিসেম্বরে বেতনের সঙ্গে বর্ধিত বেতন পাচ্ছেন না তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি সূত্র বলেছে, সরকারি স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের তুলনায় দু’এক মাস দেরিতে হাতে নগদ পাবেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা।

মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা অধিদপ্তরের অদক্ষতা ও উদাসীনতাকে দায়ী করে বক্তব্য দিচ্ছেন শিক্ষকরা। [দৈনিক শিক্ষা ডট কম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৫] সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় সরকারি কোষাগারে দিতে হবে কি না- এর জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ টাকা যাতে স্বচ্ছভাবে ব্যয় হয়, এ জন্য আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ওই টাকা সরকারি কাজে চলে আসবে কিনা, সেটা আইনে বলা হবে। ১ মাসের মধ্যে আইন পাশের জন্য সংসদে উঠবে বলে জানান তিনি। [দৈনিক শিক্ষা ডট কম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৫]

সবচেয়ে পীড়াদায়ক হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারটিতে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বর্ধিত বেতনভাতা প্রদানের জন্য প্রস্তাবিত বর্ধিত টাকাকে বারবার লেখা হয়েছে ‘অনুদান-সহায়তা’। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই এমপিও আদেশে লেখা হয় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি অংশের বেতনভাতা। বেসরকারি শিক্ষকরা কি বিনা কাজে টাকা চাচ্ছেন যে তাদের প্রদত্ত সরকারি টাকাকে বেতনভাতা না বলে অনুদান-সহায়তা বলা হলো?

বারবার শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণœ করার এহেন অপচেষ্টা করে সরকারের ওপর অসন্তোষ সৃষ্টির পেছনে কোনো বিশেষ আমলা, নেতাদের কারসাজি আছে কিনা এমন প্রশ্ন জাগা এখন নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়? তা না হলে, যা হওয়ার তা সঠিক সময়ে না করে এবং যা না হওয়ার তা বারবার করে কেন ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা শিক্ষা ক্ষেত্রের এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে? শিক্ষা ক্ষেত্রে এত এত শুভ কাজ করার এবং হাতে নেয়ার পরও কেন বারবার বিতর্কিত হয়ে, জনরোষে পড়ে, মাথা হেট করে বদল করতে হচ্ছে সরকারি সিদ্ধান্ত?

মো. রহমত উল্লাহ্ : অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0063920021057129