খুদে শিক্ষার্থীর ওপর ভয়ানক চাপ

মো. আবু হানিফ ভূইয়া |

child studentআমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে যদিও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর ধরা হচ্ছে, কিন্তু দেশে এখনও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর ধরে কার্যক্রম চলছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের পাঠ্যপুস্তকও সে আদলে প্রণয়ন এবং সে আলোকে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে মুখস্থ নয়, আত্মস্থ করতে হবে। যুগোপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন মানে ভালো বীজ বপন করা।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রণীত Text bookগুলো যথেষ্ট মানসম্মত এবং বৈশ্বিক সমসাময়িক; কিন্তু পাঠদান পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ঠিক এর উলটো। অর্থাত্ পাঠদান পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পাঠ্যপুস্তকের আলোকে নয় বরং বাজারে প্রচলিত গাইড বই-এর উপর নির্ভরশীল।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তৃতীয় শ্রেণির প্রাথমিক বিজ্ঞান বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায় (বায়ু)-এ ‘আমরা বায়ু সাগরে ডুবে আছি’—এর প্রমাণের জন্য যে পরীক্ষা দেওয়া আছে তা যদি কোনো শিক্ষার্থী পড়ে, তাহলে সে গ্লাস, বালতি নিয়ে বসে যাবে। এতে শিক্ষার্থীর বিজ্ঞান মনস্কতা ও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ, এমনকী আমাদের চারপাশ নিয়ে জানার কৌতূহল বাড়বে। এভাবে প্রত্যেকটি Text book-এর প্রতিটি অধ্যায়ে শিক্ষার্থীর মেধা বিকাশ এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট উপাদান আছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ঘড়ি বালক, আহমদ’-এর কথা সবারই জানা আছে—সে শিক্ষককে খুশি করার জন্য বাসা থেকে ঘড়ি তৈরি করে নিয়ে এসেছিল। শ্রেণি-শিক্ষক যদি এ ধরনের অনুশীলনে অভ্যস্ত করান তাহলে আমাদের দেশেও এরকম অনেক বালক তৈরি হবে।

তবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ত্রুটি রয়েছে বলে মনে করি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ের প্রত্যেকটিতে ২২টি গল্প ও কবিতা এবং চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজিতে ২৬টি Unit রয়েছে। এতগুলো অধ্যায় বা Unit কে আত্মস্থ করা নিশ্চয় একটি ক্ষুদে শিক্ষার্থীর জন্য বিশাল চাপ। এতে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বাচ্চাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, খেলাধূলা, চঞ্চলতা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ইত্যাদি।

রসায়নের ভাষায় বলা হয় ‘কম খরচে কম সময়ে বেশি উত্পাদক তৈরি করা।’ সুতরাং কম সিলেবাস প্রণয়ন করে উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে কম সময়ে পড়ালে শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মস্থ করতে পারবে। এতে বেশি আউটপুট পাওয়া যাবে।

প্রশ্নপত্রে সৃজনশীলতা এ বিশাল সিলেবাসের সঙ্গে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়া হয়।

একটি দশ-এগারো বছরের শিশুকে যদি ৩-৪ পৃষ্ঠাব্যাপী প্রশ্ন দেওয়া হয় এবং এটা পড়ে যদি ৪০-৫০টি ছোট বড় প্রশ্নের উত্তর লিখতে হয় তাহলে ভাবুন তো কত বড় ভয়ানক চাপ তার ওপর দেওয়া হচ্ছে। আমরা কি ভেবে দেখেছি, কয়টা শিক্ষার্থী শুধু পুরো প্রশ্নটা পড়তে পারবে? আর তা বুঝে উত্তর দেওয়া থাক দূরের কথা।

আরো করুণ দশা হচ্ছে ইংরেজি ও বাংলা বিষয়ে Seen passage-এর পাশাপাশি Unseen passage পড়ে প্রশ্নের উত্তর লেখা। যেখানে পুরো বই পড়েও একটি শিশু পাস করতে পারবে কি না অনিশ্চয়তা থেকে যায়, সেখানে Unseen passage পড়ে উত্তর দেওয়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষা ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রণীত পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই কোমলমতি শিশুদের বাঁচানো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। একজন নাগরিক হিসেবে এই অধিকার আদায়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর নিচের সুপারিশগুলো পেশ করছি—

১. পাঠ্যপুস্তকে অধ্যায়/ Unit :সংখ্যা কমিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পদ্ধতি প্রাণবন্ত করা।

২. ২০১৬ সাল থেকেই দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্নসহ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ করা।

৩. প্রশ্নপত্র প্রণয়নে অধ্যায়ভিত্তিক অনুশীলনী থেকে সরাসরি ৬০%, পাঠ (Lesson) থেকে ২০% এবং পাঠ্যবইয়ের সামঞ্জস্য রেখে বহির্ভূত হিসেবে ২০% ব্যবহার করা।

৪. গাইড বইয়ের অপব্যবহার রোধে এবং পাঠ্যবইয়ের ওপর দখলদারিত্ব বাড়ার নিমিত্ত প্রত্যেক স্কুলে বিষয়ভিত্তিক পাঠ সহায়িকা শিক্ষকের জন্য সরবরাহ করা।

লেখক: মো. আবু হানিফ ভূইয়া, কুমিল্লা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052809715270996