টেস্ট পরীক্ষায় ‘ফেল বাণিজ্য’ ঠেকাতে বোর্ডগুলোর নয়া কৌশল

তালুকদার আল আমিন |

টেস্ট পরীক্ষায় এক/দুই বিষয়ে ‘ইচ্ছাকৃত ফেল’ করিয়ে বোর্ড পরীক্ষার ফরম পূরণে মোট অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া কতিপয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পুরোনো কৌশল।

ইচ্ছাকৃত ফেল ও টাকা আদায় ঠেকাতে শিক্ষাবোর্ডগুলো নতুন তৎপরতা শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে আগামী বছর থেকে টেস্ট পরীক্ষার মূল্যায়ন করা উত্তরপত্র সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে দেখানো বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

ঢাকার হলিক্রস স্কুল ও কলেজে বহুবছর যাবত টেস্টের খাতা দেখানোর নিয়ম চালু রয়েছে।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। ৩ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা শুরুর চিন্তা রয়েছে। এই দুই পরীক্ষাকে সামনে রেখে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে এসএসসির বা দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা নেয়া হয়। নভেম্বর-ডিসেম্বরে নেয়া হয় এইচএসসির বা দ্বাদশ শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা।

গত সপ্তাহে দৈনিকশিক্ষায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, পটুয়াখালীর কালাইয়া ইদ্রিস মোল্লা ডিগ্রি কলেজে এবার মোট ৩৪৫ জন দ্বাদশ শ্রেণীতে টেস্ট পরীক্ষা দেয়। এদের মধ্যে ১৬০ জনই ফেল করেছে। এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৪০০০ করে টাকা নিয়ে এইচএসসির ফরম পূরণ করানো হয়েছে।

শিক্ষাবিষয়ক দেশের একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিকশিক্ষাডটকমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিতর্কিত ও শিক্ষাকে ব্যবসায়ে পরিণত করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত ক্যামব্রিয়ান, কিংস, মেট্রোপলিটন, কুইন্সসহ কয়েকটি ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠান ‘ইচ্ছাকৃত ফেল’সহ নানা অপকর্মের পথ প্রদর্শক। পরে এই ব্যাধি গ্রামেও পৌঁছেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ক্যামব্রিয়ানের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয় হয়নি। বরং অনেক অফিসারের “বখে” যাওয়া  ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়স্বজন ক্যামব্রিয়ানে ভতি করিয়ে জিপিএ ফাইভ পাওয়ানোর নজির রয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বোর্ডগুলোর সমিতির নির্বাচনে নেতাদের পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করেন ক্যামবিয়ানসহ কয়েকটি দাগী প্রতিষ্ঠান।

টেস্টে ফেলবাণিজ্য ঠেকানোর নতুন কৌশল বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও পরীক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন বোর্ডের সাব-কমিটির প্রধান শ্রীকান্ত কুমার চন্দ সাংবাদিকদের বলেন, বলেন, ‘প্রতিবছরই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে টেস্টে ফেল করিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছ থেকে। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার করা যাচ্ছে না। এ কারণে আমরা এই বিধান করতে যাচ্ছি। বিষয়টি আগামী বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার রুটিনেও উল্লে করে দেব।”

দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের ইতিহাসে সবচাইতে জুনিয়র পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শ্রীকান্ত কুমার চন্দ সাবেক এপিএসর বন্ধু ও উপদেশদাতা হিসেবে শিক্ষামহলে পরিচিত।  এই পদে যোগ দেওয়ার আগে প্রায় ৪ বছর তিনি বোর্ডের কলেজ ইনেসপেক্টর ছিলেন। এই সময়ে মন্ত্রণালয়কে পাস কাটিয়ে শত শত ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছেন তিনি । মূলত বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের সহযোগি অধ্যাপক শ্রীকান্ত। শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি উপ-সচিব হওয়ার আশায় দুই মাস আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আবেদন জমা দিয়েছেন। আগামী মাস নাগাদ উপ-সচিব হওয়ার সরকারি আদেশ জারি হলে শ্রীকান্ত আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের পদে চাকুরি করতে পারবেন না। তিনি তখন থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হয়ে যাবেন।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শিক্ষাবিষয়ক যাবতীয় তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে সর্ববৃহৎ আর্কাইভ রয়েছে দৈনিকশিক্ষার। আর্কাইভে থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকডজন তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০০৪ ও ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই টেস্ট পরীক্ষায় ব্যাপক ‘ফেল বাণিজ্য’ শুরু হয়। এই সময় থেকেই মন্ত্রণালয় বিধান চালু করে, শিক্ষার্থী ফেল করলে প্রতিষ্ঠানের এমপিও স্থগিত করার।

টেস্টে একাধিক বিষয় বিশেষ করে ইংরেজি কিংবা গণিতে ফেল করা শিক্ষার্থীকে বোর্ড পরীক্ষায় সুযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত কয়েকযুগ যাবত চালু রেখেছে প্রকৃত ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো। সেইসব ফেল নিয়ে অভিভাবকদেরও কোনও অভিযোগ ছিলন না প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে। তাদের ভরসা ও বিশ্বাস ছিল প্রকৃত শিক্ষকদের ন্যায্যভাবে খাতা মূল্যায়নের ওপর।

তবে, শিক্ষাবোর্ডগুলো যখন থেকে পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ শতভাগ পাসের তালিকা, শতভাগ জিপিএ ফাইভের তালিকা ইত্যাদিক করা শুরু করলো ঠিক তখন থেকেই ক্যামব্রিয়ান, কুইন্সসহ নানা ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানে শতভাগ পাস, শতভাগ জিপিএ ফাইভের তালিকায় থাকতে মরিয়া ওঠে।

দৈনিকশিক্ষার হাতে থাকা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে ক্যামব্রিয়ান সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই প্রতিষ্ঠানটি ভালো ফলের যে দাবী করেছে তাই বাস্তবসম্মত নয়। বোর্ড নির্ধারিত পাস নম্বর ৩৩ হলেও ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজে টেস্টে পাস নম্বর ৫০ এমনকি ৬০ যা অবৈধ।” শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে আরো বলা হয়, এভাবে টেস্টে ফেল দেখিয়ে শত শত শিক্ষার্থীর জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে। পাবলিক পরীক্ষার কয়েকমাস আগে ফেল বাণিজ্যের শিকার এসব শিক্ষার্থীরা না পারে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা দিতে না পারে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ফরম ফিলআপ করতে।”

বাঙালি জাতির শতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম সেরা শিক্ষা সংস্কারক নজরুল ইসলাম খান ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাসচিব পদে যোগ দিয়েই এসব ‘ফেল বাণিজ্য’ ঠেকাতে একটি নিয়ম চালু করেছিলেন। একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়েছিলন টেস্টে এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের ৭০ ভাগ উপস্থিতির বিষয়টি আমলে নিয়ে তাদেরকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। একইসঙ্গে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় যেসব বিষয়ে শিক্ষার্থী ফেল করবে, ওইসব বিষয়ের শিক্ষককে জবাবদিহি করতে হবে।

কিন্তু কতিপয় আজ্ঞাবহ শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক শিক্ষা ব্যবসায়ীদের ইঙ্গিতে ওই পরিপত্রের বিরোধীতা শুরু করেন। প্রায় ১৫ বছর যাবত শিক্ষা-ব্যবসায়ীদের খপ্পড়ে থাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই পরিপত্রটি বাদ দেয় কতিপয় শিক্ষাব্যসায়ীদেরই ইঙ্গিতে।

বর্তমানে ১০টি শিক্ষাবোর্ডের অধিকাংশের চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মন্ত্রীর বিতর্কিত সাবেক এপিএস-এর নিয়ন্ত্রণে। অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা আর্থিক কেলেংকারির অভিযোগ। তাই খাতা দেখানোর নতুন নিয়মও কতটা কার্যকর হয় তা নিয়ে সংশয় রয়েছে শিক্ষা গবেষক ও বিশ্লেষকদের।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0048518180847168