শিক্ষাপঞ্জিতে উপেক্ষিত বৈসাবির ছুটি, পাহাড়ে ক্ষোভ

তনুজা আকবর |

সরকারের শিক্ষা বিষয়ক দুটি মন্ত্রণালয় শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পার্বত্য এলাকায় বর্ষবরণের উৎসব বৈসাবির ঐচ্ছিক ছুটি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ বৈসাবি উৎসব উপলক্ষে দুই দিন ঐচ্ছিক ছুটি রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল গত বছর ১৫ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে।

ওই দুই দিন হলো ২৯ চৈত্র এবং ২ বৈশাখ।

১৫ নভেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০১৬ সালের জন্য ওই ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এ কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রণীত ছুটির তালিকায় এ নিয়ে বৈপরীত্য রয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত সরকারি/বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের শিক্ষাপঞ্জি ও ছুটির তালিকায় ১২ এপ্রিল বৈসাবি উপলক্ষে একদিন ছুটি রাখা হলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত সরকারি/বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের ছুটির তালিকায় বৈসাবির কোনো ছুটিই রাখা হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার লেখক-সাংবাদিক উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা দৈনিকশিক্ষাডটকমকে বলেন, এটি পার্বত্যাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবির প্রতি সরকারের মনোভাবের প্রতিফলন হয়নি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচিত বৈসাবির ছুটি অন্তর্ভুক্ত করে সংশোধিত ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও উচিত একদিন নয় ন্যূনতম দুই দিনের ঐচ্ছিক ছুটি প্রবর্তন।

boishabiদীঘিনালার মহালছড়ি হেডম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিভা ত্রিপুরা বলেন, বৈসাবিতে ছুটি থাকুক বা না থাকুক, চাকরি রক্ষার্থে শিক্ষকরা উপস্থিত হলেও পার্বত্যাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভিন্ন ভিন্ন নামের ঐতিহ্যিক উৎসবের একটি নাগরিক নাম হলো বৈসাবি। ত্রিপুরাদের বৈসুক থেকে ‘বৈ’, মারমাদের সাংগ্রাই থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের বিজু থেকে ‘বি’ নিয়ে একত্রে পার্বত্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম রাখা হয়েছে বৈ-সা-বি । চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা ও রাখাইনদের এই উৎসবে রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির ১০ ভাষাভাষী ১১টি সম্প্রদায়ের পাহাড়ি অংশগ্রহণ করে। উৎসব হয় কক্সবাজার এবং পটুয়াখালিতে বাঙালিরাও যোগ দেয় উৎসব আনন্দে। আদিবাসীদের সবাই প্রায় একই সময়ে এই উৎসব পালন করে।

বাংলা বছরের শেষ দুদিন এবং নববর্ষের প্রথম দিন উৎসবটি পালিত হয়। আদিবাসীদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে বৈসাবির যেমন ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে, তেমনি উৎসবের তিনটি দিনের নামও আলাদা।

ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের লোকজন উৎসবের প্রথম দিনকে হারি বৈসুক, দ্বিতীয় দিনকে বিসুমা ও তৃতীয় দিনকে বিসিকাতাল বলে।

মারমারা প্রথম দিনকে সাংগ্রাই আকনিয়াহ, দ্বিতীয় দিনকে সাংগ্রাই আক্রাইনিহ ও শেষ দিনকে লাছাইংতার বলে।

চাকমাদের কাছে আবার এগুলো ফুল বিজু, মূল বিজু ও গোজ্যেপোজ্যে দিন হিসেবে পরিচিত। উৎসবের প্রথম দিনে ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়।

এদিন পাহাড়ি ছড়া বা নদীতে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরোনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়।

উৎসবের দ্বিতীয় দিনে থাকে প্রতিটি ঘরে নানা মুখরোচক খাবার। বিশেষভাবে করা হয় ঐতিহ্যবাহী পাজন। পাজন নামের এ খাবার কমপক্ষে ২০ ধরনের শাকসবজি দিয়ে তৈরি করা হয়।

তৃতীয় দিনে দল বেঁধে মন্দিরে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। এ ছাড়া চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান তো থাকেই। মন ছুঁয়ে যাওয়ার অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম চাকমাদের বিজু নৃত্য, ত্রিপুরাদের গরাইয়া নৃত্য এবং মারমাদের জলকেলি ইত্যাদি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গলকুমার চাকমা দৈনিকশিক্ষাডটকমকে বলেন, বৈসাবির ছুটি সরকারের শিক্ষা সংক্রান্ত দুই মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকার ভুলটি সম্পর্কে এখনো তার জানা হয়নি। তবে যদি এটি হয়ে থাকে, একে তুচ্ছ করে দেখার সুযোগ নেই। মন্ত্রিসভায় ছুটি নিয়ে যে সিদ্ধান্ত হলো তা না মেনে কেমন করে দুটি মন্ত্রণালয় পৃথক ছুটির তালিকা করে, এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া দরকার।

তার মতে, প্রকৃতপক্ষে সরকার আদিবাসীদের দেখাতে চায়, তারা তাদের ভাষায় ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী’র প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল, তাদের উৎসব-আয়োজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সরকারের পক্ষে যা বলা হয় তা করা হয় না, সেই দৃষ্টান্ত তো পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা থেকেই বোঝা যায়।

তিনি বলেন, আমার জানা মতে, সরকারি ছুটির বর্ষপঞ্জিতেও বৈসাবির ছুটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাহলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন এমন ভুল করবে?

জাবরাং জনকল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, বৈসাবি পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় উৎসব বলে বিবেচিত হয়। তাই ঐচ্ছিক ছুটি থাকুক বা না থাকুক, পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ ছুটি নিয়েই বৈসাবিতে নিজ নিজ বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করে।

“তবে ঐচ্ছিক এই ছুটিটি পার্বত্যবাসীর প্রাপ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষা নিয়ে কর্মরত শীর্ষস্থানীয় এই উন্নয়ন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে বৈসাবির ছুটি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবেন বলে জানালেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবহিত করবেন।”

উল্লেখ্য, ১৫ নভেম্বরের বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উৎসব পালনের জন্য চার দিনের বিশেষ স্থানীয় বা ঐচ্ছিক ছুটির জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল।

ওই প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করলে দুই দিনের ঐচ্ছিক ছুটি অনুমোদিত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সদস্যরা যেখানেই সরকারি চাকরি করবেন সেখানেই তারা এই ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করতে পারবেন বলে জানানো হয়েছিল।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044610500335693