ছুটির দিন হলেও গতকাল শুক্রবার ছিল চলতি শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন। এদিন দেশের সব স্কুলেই আয়োজন করা হয় বই উত্সবের। শিশুরা স্কুলে এসেছে, নতুন বই বুকের কাছে আগলে রেখেছে। শুঁকেছে ঘ্রাণ।
তাদের চোখে-মুখে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে নতুন দিনের স্বপ্ন। নতুন ক্লাসে উঠে প্রথম দিনই হাতে বই পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ছিল বেশ উচ্ছ্বসিত। নগর, মফস্বলের পাশাপাশি প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলোও বাদ পড়েনি এই উত্সবের ছোঁয়া থেকে।
২০১০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত হয় ২০১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১ জানুয়ারি বই উৎসবের মাধ্যমে বই বিতরণ শুরু করা হবে সারাদেশে একযোগে।
গতাকালও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বই উত্সব হবে, ঘোষণা ছিল আগে থেকেই। এ কারণে ঘড়ির কাঁটায় সময় মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা হাজির হয় স্কুলে। অনেকে সঙ্গে নিয়ে আসে বাবা-মাকে। রাজধানীর একটি স্কুলের শিক্ষার্থী সালমা জানায়, ‘নতুন বই নিয়ে বাড়ি ফিরব। নতুন বইয়ে মলাট দিয়ে কাল বই নিয়ে স্কুলে যাব।’রুপসী ৫ম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলল, ‘আজকে অনেক ভালো লাগছে।’৮ম শ্রেণির হাফিজার মতে, বছরের সেরা দিনটিই আজ।
‘নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকে ফুলের মতো ফুটব, বর্ণমালার গরব নিয়ে আকাশ জুড়ে উঠব’—এমন স্লোগানকে সামনে রেখেই এবার দেশ জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় বই উত্সব। প্রতিটি স্কুলই কম-বেশি উত্সব আয়োজনের মধ্য দিয়ে বই বিতরণ করে।
বছরের প্রথম দিনে গতকাল দেশের সকল প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক স্কুল, দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানের ৪ কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু হয়েছে।
বই উত্সবে শিক্ষামন্ত্রী: শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল চত্বরে বিনামূল্যের বই বিতরণ উত্সব উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে ওই স্কুল ছাড়াও বিসিএসআইআর হাইস্কুল, ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কামরুননেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং হাফেজ আবদুর রাজ্জাক দাখিল মাদ্রাসার কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে।
ছাত্রছাত্রীরা নেচে-গেয়ে, আনন্দ-উল্লাস করে, লাল-সবুজ প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন নেড়ে, বেলুন উড়িয়ে এক উত্সবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে। মন্ত্রীর হাত থেকে নতুন বই পেয়ে তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী নতুন বই উঁচু করে নাড়াতে থাকে।
শিক্ষামন্ত্রী প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষার্থীকে নববর্ষের শীতের স্নিগ্ধ সকালে নতুন বইয়ের গন্ধ-মাখা শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, ‘অনেক প্রতিকূলতা ও বাধার মধ্যেও বছরের প্রথম দিবসে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পেরে আমরা ভীষণ আনন্দিত।
এতকিছুর মধ্যেও যথারীতি বই ছাপানো, বাঁধাই করা ও সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া সত্যিই অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল।’
শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র পাল, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাদ প্রমুখ বক্তৃতা করেন।
এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয়ভাবে পাঠ্যপুস্তক উত্সব অনুষ্ঠিত হয় মিরপুরের ন্যাশনাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান উত্সবের উদ্বোধন করেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব হুমায়ুন খালিদ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩১ ডিসেম্বর গণভবনে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক স্কুল, দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের হাতে।
বইয়ের সংখ্যা : ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিকে ৩৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৭৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬৫ লাখ ৭৭ হাজার ১৫৪টি বই বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া প্রাথমিকের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের ২ কোটি ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ৭৩১ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩৩টি বিষয়ের ১০ কোটি ৮৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৭টি বই, ২৭ লাখ ৩ হাজার ৯৮৪ জন ইবতেদায়ি শিক্ষার্থীর জন্য ৩৬টি বিষয়ের ১ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৫টি বই, মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের ১ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ১৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১১৪টি বিষয়ের ১৬ কোটি ৩০ লাখ ৪ হাজার ৩৭৩টি বই, এসএসসি ভোকেশনালের ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৮টি বিষয়ের ২২ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৬টি বই এবং দাখিল ও দাখিল ভোকেশনালের ২৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৬৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৮৮টি বিষয়ের ৩ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৭টি বই বিতরণ করা হচ্ছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল পাঠ্যবই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে ই-বুক ফর্মেও দেয়া আছে। এখান থেকে যে কেউ তা ডাউনলোড করতে পারবেন। এনসিটিবি’র ওয়েবসাইট ঠিকানা িি.িহপঃন.মড়া.নফ ও িি.িবনড়ড়শ.মড়া.নফ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবারের বই তৈরির কাজে দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত ছিলেন। মুদ্রণে ৮৫ হাজার ৮০৯ মেট্রিক টন কাগজ ব্যবহূত হয়েছে। পরিবহন কাজে ট্রাক ব্যবহূত হয়েছে ১৬ হাজার ৫০০টি। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ছিল ২৮৬টি। এবার প্রাথমিক স্তরের ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকসমূহ এবং ট্রাই-আউট কার্যক্রমের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকসমূহ পরিমার্জন করা হয়েছে।
অনেক শিক্ষার্থীই সব বই পায়নি: গতকাল শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে সব শিক্ষার্থীর হাতেই বই পৌঁছানো হয়েছে। তবে বেশ কিছু শিক্ষার্থীই সব বই পায়নি। রাজধানীর মনিপুর স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, তারা মাধ্যমিকের বেশিরভাগ বই পেয়েছেন। প্রাথমিকের সব বই পাননি। তবে যে বই স্কুলে পৌঁছানো হয়েছে তা শুক্রবারই বিতরণ করা হয়েছে।
রাজধানীর একটি মডেল স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা শ্রেণি ভেদে ২ থেকে ৪টি বই পেয়েছে। লালবাগের একটি স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক আবুল বাসার হাওলাদার জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিকের সব বই পেলেও প্রাথমিকের কম বই পেয়েছে। তিনি বলেন, বাকি বই পেলেই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
বরিশাল বিভাগের একটি স্কুলে প্রাথমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই দেয়া হয়েছে। বাকি বই পরে দেয়া হবে বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।