অবিশ্বাস্যভাবে পরিবর্তন এসেছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষায়। কয়দিন আগেও যখন নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যত ছিল অনিশ্চিত আজ তারা স্বপ্ন দেখছে দেশ গড়ার কারিগর হওয়ার। তিন দিকে পাহাড় আর একদিকে হাওর বেষ্টিত শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিক্ষার হার ছিল অনেক নিচে। স্কুলগামী ছাত্রের চেয়ে ঝরে পড়ার হারই ছিল বেশি। এর প্রধান কারণ ছিল শ্রীমঙ্গলের ভু-খন্ডের ৫৫ ভাগই চা বাগান অধ্যুষিত অন্যদিকে হাওর পাড়ে বিশাল এক জনগোষ্ঠী বরাবরই ছিল অবহেলিত। তাদের প্রধান অন্তরায় ছিল বিদ্যালয় সংকট, অনুন্নত রাস্তাঘাট। বংশ পরম্পরায় তারা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত।
একজন চা শ্রমিকের স্বপ্নের মধ্যেও ছিল না তার ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়বে, শিক্ষিত হবে। আর হাওর পাড়ের একটি জেলে পরিবারের কর্তা বাক্তির ধারণা ছিল তাার ছেলে তার চেয়েও মাছ ধরায় পটু হবে। এ দুই শ্রেণীই ছেলে মেয়েরা শৈশব থেকেই বিদ্যালয়ের পরিবর্তে শিক্ষা নিতো চা বাগানের কাজ ও মাছ ধরার কাজের। এই অবস্থায় এ এলাকায় শিক্ষার হার বাড়বে ভাবাই যেতো না, এটাকে অসম্ভব বলেই ধরে নিয়েছিলেন এখানকার মানুষ। কয়েক বছর আগে যখন এ উপজেলায় স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ ভাগ এখন স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা প্রায় শতভাগ। আর এই বিশাল পরিবর্তন এসেছে বিগত ৫/৬ বছরে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১০ সালে শ্রীমঙ্গলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬৬টি। আর ২০১৩- সালে এর সংখ্যা দাড়িয়েছে ১৩৮টি।
কিছু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় করণের পাশাপাশি শ্রীমঙ্গলের প্রত্যেকটি চা বাগানে একটি করে ও স্কুলবিহীন গ্রামে একটি করে সম্পূর্ণ নতুন স্কুল স্থাপন করে তা জাতীয়করণ করা হয়। আর সে সময় সরকারি শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩শ থেকে বেড়ে বর্তমানে সরকারি শিক্ষকের সংখ্যা ৭০৪ জন। এর ফলে শিক্ষার আওতায় এসেছে প্রায় ১০ হাজার ঝরে পড়া শিক্ষার্থী।
উপজেলা শিক্ষা অফিস ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির এক জরিপে উঠে আসে ২০১০ সালে শ্রীমঙ্গলে ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ১৩ জন, যা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পেতো। ২০১০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩০ হাজারের নিচে আর বর্তমানে বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৫ হাজারের উপরে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মোশারফ হোসেন এর পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে জানান, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা নীতি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া।
এ ব্যাপারে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, সরকার পরিচালিত অন্যান্য বিভাগের মতো প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া। পুরো অফিসকে আনা হয়েছে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের আওতায়, শ্রীমঙ্গলের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশ কিছু বিষয়ে পাঠদান করানো হয় প্রজেক্টারের মাধ্যমে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোবাশশেরুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা খুবই ভালো। ঝরে পড়ার সংখ্যা নেই বললেই চলে।
শিক্ষকরাও খুব আন্তরিকতার সহিত ছাত্রদের পাঠদান করান। এর ফলাফল হিসেবে তিনি বলেন, শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে জাতীয় পর্যায়ের কৃতিত্ব। শ্রীমঙ্গল চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জহর তরফদার এ বছর উপজেলা, জেলা ও বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে তার নাম যায়, একই ভাবে জাতীয় পর্যায়ে নাম যায় শ্রীমঙ্গল উত্তর ভাড়াউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর আগে শ্রীমঙ্গল চন্দ্রনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে।
এ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে প্রথম হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বেশ কয়েকজন অভিভাবক এ প্রতিবেদককে জানান, তাদের ছেলে মেয়ে বিদ্যালয়ে আসার জন্য উদগ্রীব থাকে। অভিভাবক তৈরী হওয়ার আগেই ছেলে মেয়েরা স্কুলে আসার জন্য তৈরি হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, বিদ্যালয়ে রয়েছে তাদের নানান খেলার সামগ্রী। খেলার ছলে তাদের শেখানো হয় লেখাপড়া। তারা বলেন, পাল্টে গেছে স্কুলের দৃশ্যপটও, হয়েছে নান্দনিক। এখন বিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই অন্যরকম এক ভালোবাসার জন্ম হয়।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন আরো জানান, দেশের অন্য যে কোন উপজেলার চেয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিক্ষার চিত্র অনেক ভালো। ২০১৬ সালে শ্রীমঙ্গলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯৯.২৯%।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা চেয়ারম্যান রনধীর কুমার দেব জানান, শ্রীমঙ্গল শিক্ষা ব্যবস্থার এ ইতিবাচক চিত্র ধরে রাখতে শিক্ষা বিভাগ, অভিভাবক, উপজেলা প্রশাসন ও সুধী সমাজ সবাইকে আরো উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ এমপি জানান, তার এলাকা শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে ছিল। তিনি এলাকার অন্যান্য উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি নিজেও অবৈতনিক শিক্ষকতা করেছি। আর যারা অবৈতনিক শিক্ষকতা করেন তারা আন্তরিক উপলব্দি থেকেই তা করেন থাকেন।