আবার সে এসেছে ফিরে

পবিত্র সরকার |

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের শিক্ষা বিভাগ প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা-প্রথা ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়েছে। পরীক্ষা ব্যবস্থা মানে ক্লাসের শেষে একটা বার্ষিক ঝাড়াই-বাছাইয়ের পরীক্ষা হবে, আগে যেমন হতো। তাতে পাস করলে কিছু ছেলেমেয়ে উপরের ক্লাসে উঠত, নতুন বইয়ের গন্ধ শোঁকার সুযোগ পেত, প্রথম দিকের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে অবস্থা বা ব্যবস্থা থাকলে একদিন ভালো খাওয়া-দাওয়া হতো। তাদের পরিচয় হতো ফার্স্ট/সেকেন্ড/থার্ড বয়/গার্ল হিসেবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ নজরে থাকত তারা। আর যারা ঊনষাটতম বা একাত্তরতম হয়েছে, তাদের অভিভাবকরা হয়তো ছেলেমেয়েকে বলতেন, ‘তোদের ফার্স্ট/সেকেন্ড বয়/গার্ল কে রে? দেখিয়ে দে তো!’

এ ব্যবস্থাটাই তথাকথিত ‘পাস-ফেল’ প্রথা। নাটটা ভালো নয়, কারণ এতে ফেল করার দায় পুরোপুরি ছাত্র বা ছাত্রীটির ঘাড়ে চাপানো হয়। মনে করা হয়, কিছু ছেলেমেয়ে পাস করবে, কিছু ছেলেমেয়ে ফেল করবে- এটা একটা নিয়তিনির্দিষ্ট স্বাভাবিক ঘটনা, এতে স্কুল, সমাজ, রাষ্ট্র কারও কিচ্ছু করার নেই। ফেল করাটা একটা বৈধ ব্যাপার। যত নজর পাসওয়ালাদের দিকে, সাফল্যের দিকে। ফেলদের নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। ওটা ওদের বা ওদের অভিভাবকদের দায়। আয় ভাই, আমরা সবাই ওদের কথা ভুলে থাকি।

ভারতে (নাকি উপহাদেশে) পাস-ফেল প্রথা উঠে গিয়েছিল কেন? ইউনেস্কোর ঠেলায় আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের মনে হয়েছিল স্কুলে বেশি ছাত্র, বিশেষত মেয়েরা, আসছে না, যারা আসছে তারাও টিকে থাকছে না। কাজেই বিপুল নিরক্ষরতা-কলঙ্কিত ভারত রাষ্ট্রের আসল কাজ ছেলেমেয়েদের স্কুলে এনে আটকে রাখা। ভাবুন একবার, শিক্ষা দেয়া নয়, স্কুলে যেমন-তেমন করে হোক, আটকে রাখা। যেন স্কুলে বসে থাকলেই ছেলেমেয়ে আপনা থেকে লেখাপড়া শিখে যাবে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই পরীক্ষা ব্যাপারটার একটা নেতিবাচক জুজুবুড়ির চেহারা তৈরি করা হয়েছিল, ধরে নেয়া হয়েছিল, ফেল করার ভয়েই অনেকে স্কুলে আসে না বা ফেল করে বলে স্কুল ছেড়ে দেয়। তাই তুলে দাও ফেল ব্যবস্থা, সেই লক্ষ্যে একই মুদ্রার ওপিঠ পাস ব্যবস্থা। ছেলেমেয়েগুলো স্কুলে থাকুক। মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা করছি, তারও একটা প্রবল টান তৈরি হবে গরিব অঞ্চলে। ব্যাস, কাম হাসিল! আর কী চাই? ভারতের শিক্ষা এবার লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাবে।

এগিয়ে যে যায়নি তারও ছবিটা স্পষ্ট। ক্লাস ফাইভে এখনও একশ’জনের মধ্যে পঞ্চাশজন স্কুল ছেড়ে দেয়।

বিকল্প ব্যবস্থা যে ছিল না, তা নয়। ক্লাসে ক্লাসে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। সেটি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায় ছিল। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকারাই সবচেয়ে বেশি করে জানেন, সেই ব্যবস্থা নিজেই ‘ফেল’ করেছে। শিক্ষক ও ছাত্রের উভয় পক্ষের বিপুল অনুপস্থিতি, ক্লাসঘরে ছাত্রছাত্রীর অতিপ্রাচুর্য ইত্যাদি এমন ব্যবস্থার সহায়ক নয়। তাই যে শিক্ষককেই জিজ্ঞেস করি, তিনিই বলেন, ক্লাস ফোর-ফাইভ-সিক্স-সেভেন-এইটে (‘প্রারম্ভিক’ বা এলিমেন্টারি পর্যায়ের শেষদিকের ক্লাসগুলোতে) পড়ানোই কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, কারণ ক্লাসে ছেলেমেয়েরা এক পর্যায়ের নয়। কারও অক্ষরজ্ঞান সম্পূর্ণ নয়, কারও অঙ্কের দক্ষতা তৈরি হয়নি, কারও অন্য জ্ঞানের ভিত্তি দুর্বল থেকে গেছে। সে ক্ষেত্রে কোন ছাত্রগোষ্ঠীর দিকে লক্ষ্য করে পড়াবেন শিক্ষক-শিক্ষিকা? যারা যারা প্রত্যাশিত মানের তলায় আছে তাদের দিকে? তাহলে তো যারা এগিয়ে গেছে তাদের প্রতি অবিচার হবে। আবার এগিয়ে থাকাদের লক্ষ্য করলে যারা পিছিয়ে আছে তারা পিছিয়েই যাবে, আরও পিছিয়ে।

এ অবস্থায় শহরের অনেক সচেতন আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিভাবক তাদের সন্তানদের টিউশনের ব্যবস্থা করেন বা কোচিংয়ে দেন। কিন্তু টিউটর তাদের গোড়ার দুর্বলতা সারানোর ব্যবস্থা না করে ওই ক্লাসের পড়া মুখস্থ করিয়ে দেন। এমন নয় যে, কোনো অভিভাবক ভাবেন না টেনেটুনে ক্লাস এইটের সার্টিফিকেট পেলেই হল, আমার সন্তান, আমি তাকে ড্রাইভিংয়ে দেব, বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বানাব, কিংবা মেয়ে হলে তার বিয়ের তকমা তৈরি হবে। এদের সংখ্যা অবশ্যই খুব বেশি নয়।

অধিকাংশ অভিভাবক ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছেন ব্যবস্থাটার নড়বড়ে চেহারা সম্বন্ধে। তাদের ছেলেমেয়ে সারা বছর পড়ে ক্লাসে উঠছে, আর অন্যেরা সেই পরিশ্রমটা না দিয়ে অবলীলায় প্রমোশন পাচ্ছে, এটা যেমন একটা কষ্টের দিক, তেমনি গ্রামের নিরক্ষর অভিভাবকরাও প্রশ্ন করছেন, ছেলেমেয়েরা ‘শিখছে’ কতটা? সারাক্ষণ স্কুলে থাকা তাদের দেহে-মনে কতটা সম্পদবান করে তুলছে? এটা হয়তো একটা ভালো লক্ষণ যে, অল্প শিখে, অনেকটা না শিখে শুধু শুধু পাস করে যাওয়াতে তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত হওয়ার মতো অভিভাবকের সংখ্যা ক্রমে কমছে।

যারা পাস-ফেলের ব্যবস্থা তুলে দিয়েছিলেন, তাদের মনে সম্ভবত এই দেশপ্রেমসিক্ত সদিচ্ছা ছিল যে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে এসে সময় কাটাক, সেটাই একটা শিক্ষা। কিন্তু ক্লাসঘরে কতটা ‘শিক্ষাদান’ চলছে, তাতে কে এগিয়ে যাচ্ছে, কে পিছিয়ে থাকছে (এরকম হতেই পারে এই অসম বিকাশের দেশে), যে পিছিয়ে যাচ্ছে তার ব্যাপারে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা- এই নজরদারি কি তারা করেছিলেন? ছেলেমেয়েদের স্কুলে আটকে রাখাটাই যথেষ্ট নয়, আসল কাজটা যে তাদের শিক্ষা দিয়ে জীবনের ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে তোলা, সেই ‘তুচ্ছ’ ব্যাপারটা সম্ভবত তাদের চোখের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু শুধু পাস-ফেল ফিরিয়ে আনলেই কি আসল ‘শিক্ষাদান’ শুরু হবে? এই অবিশ্বাসীর তো সন্দেহ ঘোচে না। ফেল যারা করবে তাদের কি ওইটাই শেষ নিয়তি হবে, তাদের সম্বন্ধে আর আমাদের ভাবার কোনো দায় নেই? রাষ্ট্র তাদের বিশেষ শিক্ষাদানের দায় নেবে না? আমাদের রাষ্ট্র যে ‘কল্যাণমূলক’ রাষ্ট্র? সে তার ভাবী নাগরিকদের এরকম চির ব্যবস্থায় নিক্ষেপ করে নিশ্চিত থাকবে? একশ’, কখনও বা আড়াইশ’জনের ক্লাসে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা ছুঁয়ে দিয়ে বলবে, যা পার করো?

এটা নিয়ে শিক্ষা-সঞ্চালক এবং শিক্ষাবিদ- সবারই মস্তিষ্কে ঝড় তোলা দরকার। এমন কোনো রাস্তা কি নেই যাতে পরীক্ষার ওপর থেকে ভয়ের মুখোশটা খুলে নেয়া যায়? পরীক্ষাটাকে একটা উৎসবের চেহারা দেয়া যায়? ভাবুন, সবাই মিলে ভাবুন। কথাটা যত অলীক আর অবাস্তব মনে হচ্ছে ততটা না-ও হতে পারে। শিশুদের পাঠ্যবই চিত্তাকর্ষক হচ্ছে দিন দিন, পাওলো ফ্রেইরে জেনে বা না জেনে ক্লাসে পড়ানোর পদ্ধতিতেও বেত্রহস্তে শিক্ষকের ছবিটি অধিকাংশ জায়গায় অন্তর্ধান করেছে- শুধু পরীক্ষাটাই রাক্ষসের চেহারা নিয়ে থাকবে?

আরেকটা কথা। কথাটা শুনতে অনেকের কানে খুব রুচিকর লাগবে না। পরীক্ষা মানেই আরও সুলভ, ব্যাপক আর লাভজনক গণটোকাটুকির ব্যবস্থাপনা- এই অভিশপ্ত ভবিতব্য থেকে যেন আমরা সব শিশুকে রক্ষা করতে পারি।

লেখক: পবিত্র সরকার, সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা;


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.016067028045654