‘ঈদ’ বানান নিয়ে সমালোচনার ঝড়

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দেশের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী শব্দ ‘ঈদ’ বানান পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। বাংলা একাডেমির এ উদ্যোগকে দেশের মানুষ তীর্যক দৃষ্টিতেই দেখছে।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ দেশের সব কবি ও সাহিত্যিক যেখানে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ‘ঈদ’ বানানেই প্রকাশ করেছেন সেখানে হঠাৎ এ পরিবর্তনের উদ্যোগকে অনেকেই নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীরও হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

বিশেষ করে তরুণ সমাজ ভার্চুয়াল জগতে এ বিষয়ে বিভিন্ন প্যারোডি লিখছেন, বাংলা একাডেমির কর্তৃপক্ষকে নিয়ে হাসি-তামাশা করছেন। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়েও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

ভাষা সৈনিক আলতাফ মাহমুদ কন্যা শাওন মাহমুদ

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানের সুরকার ভাষা সৈনিক শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ তার স্ট্যাটাসে লেখেন, শোনেন রে ভাই বাংলা একাডেমী। আমার এই বয়সে এসে নতুন করে বানান মুখস্থ করবার মগজের সেই অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং বাকী জীবন আমি ‘ঈদ’ শব্দটি ঈদ বানানেই লিখবো। কখনই ‘ইদ’ লিখবো না।

সাহিত্য সমালোচক, কবি ও ভাষাতাত্ত্বিক সাখাওয়াত টিপু তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘’ইদ’ নয়, লিখুন ‘ঈদ’। ‘ইদ’ শব্দ ভুল! এক ভাষা থেকে অন্য ভাষার শব্দ তার ভাব ও ধ্বনিগতভাবে শব্দ আত্মীয়করণ করে। গায়ের জোরে শব্দ বিকৃতকরণ ভাষার ফ্যাসিবাদ। এটা বল প্রয়োগের সংস্কৃতি!’

সাখাওয়াত টিপু আরেকটি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঈদ’ বানান এভাবে ‘ইদ’ বললে ‘ইঁদুর ইঁদুর’ কালচার মনে হয়। আরবি ‘ঈদ’ মানে ‘আনন্দ’। কিন্তু ‘ইদ’ মানে কি আনন্দ’?

 বাংলা একাডেমি বাঙালির বহুদিনের অভ্যস্ত বানান ‘ঈদ’ পরিবর্তন করে ‘ইদ’ করার প্রস্তাব করেছে। এতদিনের বানান ‘ঈদ’ এ হ্রস্ব-ই ব্যবহারের প্রস্তাবে সচেতন শিক্ষিত সমাজে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

সাংবাদিক আরাফাত সিদ্দিকী তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘অভিধানে ঈদ বানান পরিবর্তন করে ‘ইদ’ করা হয়েছে। এনিয়ে ফেসবুকে চরম প্রতিক্রিয়া চলছে। যা মনে হচ্ছে, তাতে এবার ইদ অনেকে বয়কট করতে পারে! এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’

সিলেট মদন মোহন কলেজ শিক্ষার্থী মারুফা আক্তার মাধবীর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া- ‘আচ্ছা ,ঈদকে ‘ঈদ’ লিখলে সমস্যা কি? ইদ লিখতে হবে কেন?

বাপ,দাদারা ঈদ লিখলো আমরাও লিখলাম৷ আর এখন এই বুইড়া বয়সে নতুন ইদ বানান শিখতে হইবো !!’

আরবি শব্দ ঈদ অর্থ আনন্দ আর ইদ অর্থ নারীদের ঋতুস্রাবকালীন সময় উল্লেখ করে তুহিন খান নামের ঢাবি শিক্ষার্থী তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ঈদ বানানের ‘ধর্মবোদ্ধা’-গণ ইদ্দতরেও ‘ইদ’ বানায়া দিছে। এইবার দেখেন, মহিলারা ‘ইদ’ পালন করবেন, না ‘ইদ্দত’। ইদ্দত মোবারক।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর লেখেন, ‘’ঈদ’ বানানকে ‘ইদ’ বানাবার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আমার কাছে একটাই- বেকারের আড্ডাস্থল বাংলা একাডেমিতে কাজের অভাব হয়েছে। ‘ঈদ’ বানানটার সাথে কতশত স্মৃতি জড়িত। ছেলেবেলায় বই কেনার মৌসুম ছিল ঈদ মৌসুমেই। নানা ম্যাগাজিনের ঈদ পর্বে কতশত লেখকের লেখা পড়ে দিন কেটেছে আমাদের। ঈদ ব্যাপারটা মনে হলে বাংলায় যা আমার মাথায় আসে সেটা হলো ‘ঈদ’ বানানটার উপরে একটা চাঁদ।

নয়া- ইদ বানানটা দেখতে ন্যাংটো বাচ্চার মত। ঈদের সাথে যাচ্ছে না, অথবা অভ্যস্ত নই বলে ভালো লাগছে না। সে যাই হোক, এটা নিশ্চিত বাংলা একাডেমি খই ভেজেও সময় শেষ করতে পারছে না ‘

জনপ্রিয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ব্রাত্য রাইসু লেখেন, ঈদরে ‘ইদ’ হিসাবে চালানোর চেষ্টায় বাংলা একাডেমি ধরা খাবে। পাখীরা বরং ফেরত আসতে পারে।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র সালেহ খান বাবলু তার স্ট্যাটাসে লেখেন, ঈদকে `ইদ` বানানো বাংলা একাডেমির বিদেশি ভাষার ওপর অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ!

`ঈদ` আরবি শব্দ। অর্থ- আনন্দ, উল্লাস, উৎসব। পক্ষান্তরে `ইদ` লিখলে অর্থের বিকৃতি ঘটবে। সুতরাং আনন্দ, উল্লাস, উৎসব বুঝাতে

`ঈদের` বিকল্প নেই।’

সিলেট থেকে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ নামের একজন লেখেন, শত আফসোস তাঁদের জন্য, যাঁরা আরবী শব্দের বেলায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৈরিকৃত ইসলামী শব্দের বানাননীতিকে বাদ দিয়ে বাংলা একাডেমির বানানকে পথিকৃত মনে করেন। তবে বাংলা শব্দের ব্যাপারে অনুসরণ করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

নিয়মে বলা আছে ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর বানান পরিবর্তন করা যাবে না। যেমন- ‘আওয়ামী লীগ’। এ বানানটি প্রমিত বানান হিসেবে দুটোই হ্রস্ব-ই-কার হওয়ার কথা, কিন্তু এ নিয়ম এখানে প্রযোজ্য নয়। কারণ হিসেবে বলা হয় এ নামটি ঐতিহ্যবাহী। ৬০-৭০ বছর বয়সী একটি বানান যদি ইতিহাস-ঐতিহ্যনির্ভর হয়, তা হলে যে সমস্ত আরবী শব্দের বাংলায় প্রবেশ ঘটেছে, সেগুলো কি শত-সহস্র বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিনির্ভর নয়? অথচ বাংলা একাডেমি নিজেই স্ববিরোধী। নিয়ম হিসেবে হওয়ার কথা ‘অ্যাকাডেমি’; কিন্তু তাঁরা লিখেন ‘একাডেমি’। এমনকি বানান বিভ্রাটের জন্যও কম দায়ী নয়। অভিধানে ‘একাডেমি, অ্যাকাডেমি’ দুটোই দেখানো হয়েছে।

জুলফিয়া ইসলাম নামের একজন লেখেন, বাংলা একাডেমি বলেছে,ঈদ/ইদ দুটোই শুদ্ধ। ‘ইদ’ বাংলা একাডেমির অপ্রচলিত বানান, ভুল নয়।প্রচলিত হচ্ছে ‘ঈদ’। এদিকে আরবি ব্যাকরণ মানতে গেলে ‘ঈদ’ ঠিক আছে। আরবি ব্যাকরণে দুই হরফের মাঝে ইয়া থাকলে উচ্চারণ দীর্ঘ হয়। এখানে আঈন ও দালের মাঝে ইয়া আছে।তবুও অধিকাংশক্ষেত্রেই আমরা আরবি ব্যাকরণ মানি না।যেমন আমরা ‘রাহমান’কে ‘রহমান’ বলি।আবার অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলেও এ বানান শুদ্ধ। যেমন, বিদেশী শব্দ বাংলায় লিখতে গেলে ‘ষ’এর স্হানে ‘স’ তেমনি ‘ঈ’এর স্থানে ‘ই’ হয়। ‘ইদ’ বাংলা একাডেমির অপ্রচলিত বানান হলেও নতুনরা সেটা চালু করে দিয়েছে।আমার, মতে দুটো অপশান রাখলে প্যাঁচ লেগে যেতে পারে।তাই যে কোনো একটি শব্দ নির্দিষ্ট করে দিলেই ভালো হতো। হয়তো একসময় এভাবেই ‘ই’ দিয়ে ঈদ চালু হয়ে যাবে।একটাসময় আমরা ‘বৌ’ লিখেছি, এখন লিখি ‘বউ’। তবুও এতোদিনকার অভ্যাস।নতুন জেনারেশন বোধহয় সহজটাই নিয়ে নেবে। আর আমরা? বহুদিনের কষ্টার্জিত শব্দ নতুনভাবে লিখতে গেলে বারবার হোঁচট খাবো বৈ কি!আমরা থেকে যাবো ‘ঈদ’এ আর নতুনরা সহজ খুঁজতে গিয়ে ‘ইদ’ এ যাবে।লাগবে ভাষার মারপ্যাঁচ।

এদিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষকে জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘ-ঈ ব্যবহার করতেন। তাহলে কেন ঈদ বানান হ্রস্ব-ই দিয়ে লেখার প্রস্তাব আসল?

এর জবাবে তিনি বলেন, ঈদ শব্দটি বাংলার এবং বাঙালির উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কোনো কোনো বানান থাকে যার পরিবর্তন হলে চোখে লাগে। কখনো কখনো আবেগে লাগে, কখনো কখনো বিশ্বাসে লাগে। এর ফলে সমাজে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। ফেসবুকে অনেকেই এর প্রতিবাদ করে লিখছে। আমার মনে হয় কিছু কিছু শব্দ ব্যতিক্রম বানান নিয়ে থাকতে পারে। যেমন ঈদ এর বেলায় এমনটি হতে পারে। ঈদ বানান যেহেতু আমাদের অপটিকস সহ্য করে নিয়েছে, তাই আমার মনে হয় ঈদ বানান অপরিবর্তিত রাখলে অধিকাংশ বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে’।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়নের সহকারী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ বলেন, সব শব্দের বাংলায়ন কতখানি জরুরি? আরবি শব্দ ‘ঈদ’ এর অর্থ আনন্দ। কিন্তু দীর্ঘ-ঈ বাদ দিয়ে ঈদ এর আগে ‘ইদ’ করা কি শুধুই বাংলা বানান সংস্কারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত? নাকি অতি উর্বর কোনো মস্তিস্কের ফল? আমার নাম তো শেখ আদনান ফাহাদ, পুরো আরবি নাম। তাই বলে এর বাংলা করতে হবে? খুব সূক্ষ্ম মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা থেকে এবার ঈদকে ‘ইদ’ করা হয়েছে। একজন বাঙালি মুসলমান হিসেবে আমি এই বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির প্রতিবাদ করছি। এর কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না’।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ - dainik shiksha এমপিও কোড পেলো আরো ১৪ স্কুল-কলেজ নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র তূর্যের মৃত্যু পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064761638641357