স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার জন্য? শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই এসব আয়োজন। শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব, উপাচার্য, অধ্যাপক, শিক্ষক, শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে আরম্ভ করে দারোয়ান-পিয়ন, শিখনসামগ্রী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘর-দরজা, আসবাব—সব কিছুই শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষার্থী না থাকলে এর কোনোটিরই প্রয়োজন থাকত না। যাদের জন্য এসব আয়োজন, অনেক ক্ষেত্রে তারাই অবহেলিত, বঞ্চিত ও মানসিক-শারীরিক চাপে অতিষ্ঠ। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তিযুদ্ধ থেকে কি শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া যায় না? দেশে দেশে যুদ্ধ হলে বিজয়ী ও বিজিত দুই দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাঝখানে লাভবান হয় অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রয়কারী দেশ। ভর্তিযুদ্ধে ভর্তি প্রার্থী শিক্ষার্থীরা বহুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, পক্ষান্তরে হয়তো শিক্ষকরা কিছুটা লাভবান হয়ে থাকেন। আরো ভালো ব্যবসা করেন কোচিং সেন্টার ও গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা। ভর্তিযুদ্ধের ক্ষতি অপরিসীম।
প্রথমত, গাঁওগ্রামের গরিব শিক্ষার্থীদের শহরে মেসে থেকে হাজার হাজার টাকা ফি দিয়ে কোচিং করার সামর্থ্য নেই। তাই সামর্থ্যবানদের সঙ্গে দৌড়ে তারা পিছিয়ে থাকে।
অনেকে অধিকতর মেধাবী হয়েও ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, অর্থের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ঘুরে ঘুরে অর্থাৎ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। মেধা থাকলেও অনেকে এভাবে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তৃতীয়ত, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা ও তাদের অভিভাবকরা ভর্তির বিষয়ে মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন। এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে পরিবারের শান্তি ও স্বাস্থ্য বিনষ্ট হয়। চতুর্থত, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ নিতে গিয়ে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে রাত জেগে ভ্রমণ করে পরদিন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এভাবে কয়েক সপ্তাহ রাত জেগে জেগে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করায় পরীক্ষা আশানুরূপ হয় না এবং অনেকের স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ে। পঞ্চমত, একই দিনে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয় না, না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হতে কয়েক মাস সময় লাগে। ফলে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস আরম্ভ হওয়ার ক্ষেত্রে চার থেকে ছয় মাস সময় চলে যায়। দীর্ঘ সময় পড়ার টেবিল থেকে দূরে থাকার পর আবার লেখাপড়ায় মন বসানো অনেকের ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে এভাবে সময়ের অপচয় হয়।
শিক্ষার্থীরাই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যমণি। তাদের স্বার্থই বড় করে দেখতে হবে। ভর্তিপ্রক্রিয়া ভর্তি প্রার্থীদের অনুকূলে করার সহজ উপায় হচ্ছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। তা করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া অত্যাবশ্যক সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—ক. এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে মূল্যায়নের যথার্থতা (Validity) ও নির্ভরযোগ্যতা (Reliability) নিশ্চিত করা এবং খ. সময় হাতে রেখে অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা নবম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার পরই জানিয়ে দেওয়া যে পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে। এতে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাবে।
উল্লিখিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে শিক্ষার্থীরা বহুভাবে উপকৃত হবে—ক. ভর্তি কোচিং বন্ধ হবে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই উচ্চশিক্ষার সমান সুযোগ পাবে; খ. অভিভাবকের পকেট খালি হবে না; গ. ভর্তি প্রার্থী ও তাদের অভিভাবকরা মানসিক দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পাবেন; ঘ. ভর্তি প্রার্থীদের রাত জেগে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াতে হবে না এবং ঙ. এইচএসসি ফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আরম্ভ করা সম্ভব হবে।
উল্লেখ্য, এসএসসির ফলের ভিত্তিতে এইচএসসিতে ভর্তি করার প্রক্রিয়া চালু করায় ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, গাইড বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। অল্প সময়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করে শিক্ষা কার্যক্রম আরম্ভ করা সম্ভব হচ্ছে।
বর্তমানে প্রচলিত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কারো কারো প্রশ্ন থাকতে পারে। এ প্রশ্ন বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করা সাপেক্ষে সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা চালু করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থায় সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা একই দিনে ও একই প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষার্থীরা নিকটস্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নেবে। শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের আবেদনপত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ও ভর্তির বিষয় পছন্দের ক্রমানুসারে উল্লেখ করবে। একটি গুচ্ছে ভর্তির জন্য একটি আবেদনপত্র এবং একবার ভর্তি পরীক্ষার ফি জমা দেবে। ওএমআরের মাধ্যমে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মেধাক্রম অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ভিত্তিক ভর্তির ফল নির্ধারণ করা হবে।
এ ব্যবস্থায় ভর্তি প্রার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না। এতে শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয় কমবে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেটি যে পর্যায়ের মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থী পাচ্ছে গুচ্ছ ব্যবস্থায়ও একই পর্যায়ের মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থী পাবে। এতে খুব একটা ব্যতিক্রম হওয়ার আশঙ্কা নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে মেডিক্যাল কলেজগুলোয় একই দিনে একই প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মেডিক্যালে সম্ভব হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব না হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?
বাংলাদেশ সরকার গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভর্তি কার্যক্রম প্রবর্তনের পক্ষে। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসনের ধুয়া তুলে তা মানছে না। গুচ্ছ প্রক্রিয়া চালুর ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমিত সমস্যা কী ও বর্তমানে চালু ভর্তিপ্রক্রিয়ার সুবিধাগুলো কী তা জাতিকে জানানো প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা দিয়েছে জাতীয় সংসদ। প্রয়োজনে জাতীয় সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে বা গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভর্তি ব্যবস্থা চালু করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপ্রক্রিয়া পরিচালিত করবে। পর্যায়ক্রমে এক এক করে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে এ দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
আবারও বলছি, শিক্ষাব্যবস্থার সব কিছু শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষার্থীদের বিকাশের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় যা কিছু আছে এসবের মধ্যে সর্বোত্কৃষ্ট হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, মহান ব্রত। শিক্ষকতার মূল উদ্দেশ্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হিসেবে শিক্ষকের শিক্ষার্থীর হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া। তাহলেই শিক্ষকের স্থান হবে সমাজে, দেশে ও ইতিহাসের সোনালি পাতায়। আসুন, আমরা সর্বাগ্রে শিক্ষার্থীদের কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত করি।
ভর্তির বিষয়ে চলতি বছরে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। ২০১৮ সালের ভর্তি কোন প্রক্রিয়ায় হবে এখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিকে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে ব্যর্থ হলে জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছার পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ রেখে শেষ করছি।
লেখক : অধ্যাপক (অব.) ও প্রাক্তন পরিচালক
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়