উপাচার্য নিয়োগে আর কত দেরি

ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ |

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই মাস ধরে কাজকর্ম থেমে আছে অর্থ ও হিসাব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং রেজিস্ট্রার দপ্তরে। পাস হচ্ছে না বেতন-বিল, প্রকাশ হচ্ছে না পরীক্ষার সূচি ও ফল। এমনকি বের হচ্ছে না কোনোরূপ অফিস আদেশ। বন্ধ হয়ে আছে নতুন শিক্ষাবর্ষে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম। বর্তমানে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের প্রতিটি পদই খালি থাকার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। এভাবে আরও কিছুদিন অভিভাবকশূন্য থাকলে শুধু উন্নয়ন কেন, প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রতীক্ষার এ প্রহরে ‘কেমন উপাচার্য আসছেন’ থেকে প্রশ্নটা ‘কবে আসছেন’ পর্যায়ে চলে এসেছে। সরকারের আশু পদক্ষেপে হয়তো দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ হবে। ধীরে ধীরে দাপ্তরিক কাজের জট থেকে সৃষ্ট সমস্যা নিরসন হয়ে যাবে। তারপর অবকাঠামোর ঘাটতি ও গুণগত সমস্যা উত্তরণকল্পে পুঞ্জীভূত অপূর্ণ উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা সামনে চলে আসবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স ১২ বছর হতে মাত্র কয়েক মাস বাকি। ভৌত অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করতে না করতেই শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল বলে পুরনো সাতটি বিভাগে ১১তম ব্যাচের শিক্ষাক্রম চলছে। সময়ান্তে বিভাগ বেড়ে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫,৪৩৮-এ পৌঁছেছে। তবে অবকাঠামোগত ঘাটতির জের রয়েই গেছে। প্রায় এক যুগ সময়কালে পাঁচজন উপাচার্য দায়িত্ব পালন শেষ করে গেলেও কেউই লাইব্রেরি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা পর্যন্ত গ্রহণ করেননি। সদ্য বিদায়ী উপাচার্যের আমলে ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছিল। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনামূলক চিত্রে অনেক কম অঙ্কের প্রকল্পটি অবশ্য ২০১৩ সালে পূর্ববর্তী উপাচার্য প্রস্তাব করেছিলেন। সমসাময়িক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকশ’ কোটি টাকার কাজ চলছে। তবে গত বছর প্রস্তাবিত ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক চারশ’ কোটি টাকার প্রকল্পটি ঈড়সঢ়ৎবযবহংরাব ঋবধংরনরষরঃু ঝঃঁফু নেই মর্মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অক্টোবর মাসে ফেরত পাঠিয়েছে। সে অবস্থায় রেখেই ডিসেম্বর মাসে তো উপাচার্য চলে গেলেন।

পরিতাপের বিষয় হলো, উপাচার্যদের বিদায়ী বছরে দেশের রাজনৈতিক ব্যবসাচক্রের চলমান ধারা বিশ্ববিদ্যালয়েও দৃশ্যমান। উল্লেখ্য, নির্বাচনী বছরে তাত্ত্বিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও প্রতি বছরেই আমাদের সূচকে মন্দাভাব ছিল। একজন উপাচার্যের আগমন ও গমনকালে তার সমাদর ও নামের সঙ্গে যুক্ত বিশেষণের সাধারণ পরিবর্তন থেকে চক্রটি বোঝা সহজ। এ জন্য তার যে দায় থাকে না, তাও বলা যায় না। শুধু কুমিল্লা কেন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কাজে অংশগ্রহণ আছে। শিক্ষার প্রসারে অগ্রগামী অঞ্চলে অবস্থিত বলেই হয়তো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি খবরই গণমাধ্যমে এসেছে। গত একটি বছর যে শিক্ষক সমিতি ও প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বে কেটেছে, তাতে কার কতটা লাভ হয়েছে? পরস্পর শ্রদ্ধাবোধে অমিল ও অবজ্ঞা থেকে বিষয়টি জটিল হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিতে আঘাত করেছে। ইতিমধ্যে আবারও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠিত হয়েছে। একই ধারার পুনর্নির্বাচিত কমিটি হয়তো আসছে, উপাচার্যকে সহায়তা করার মানসিকতা ধারণ করছে। তিনিও হয়তো নির্বাচিত পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন কাজ করবেন। মামলা-মোকদ্দমা পর্যায়ে চলে যাওয়া শিক্ষক বিভাজন দশা থেকে পরস্পর সংহতি গড়তে সচেষ্ট হবেন।

প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের পাশে স্থাপিত ছোট পরিসরের বিশ্ববিদ্যালয়টির রয়েছে প্রভূত উন্নয়ন সম্ভাবনা। শিক্ষার্থী ভর্তিতে প্রতিযোগিতা এতটাই যে, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে আসনপ্রতি লড়ছে ৫৩ জন। পরিকল্পনামন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় আকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। অথচ ক্যাম্পাসেই একটি আলোচনা সভায় মন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি বন্ধ না করলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধরনের প্রকল্প দেওয়া হবে না (প্রথম আলো, ২৭ মার্চ ২০১৭)। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে পেয়েও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সুবিধা নিতে পারেনি। সম্প্রতি তিনি জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন খাতে আটশ’ কোটি টাকার সরকারি বরাদ্দ থাকলেও কেউ চায়নি বলে অব্যবহূত থেকেছে (সমকাল, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭)। কেন যেন তিনি এখানে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অনুষ্ঠানে সংকটের কথা শুনে ও সিন্ডিকেটের অনেক সভায় অংশ নিতে এসে দেখেও কিছু টাকা দিলেন না। প্রত্যাশা করি, আগামী উপাচার্য হয়তো এসব ম্যানেজ করে উন্নয়ন চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।

দেশের ২৬তম এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত মেয়াদে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। স্বাভাবিক রীতিতে এবারও পুরনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আসবেন। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তারা সিন্ডিকেট থেকে নিয়োগ বোর্ড পর্যন্ত পূর্ববর্তী কর্মস্থলের শিক্ষকদের প্রাধান্য রাখেন। এইরূপ চর্চার অতিআধিক্যের সঙ্গে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটধারী শিক্ষকদের বলয়ে আবদ্ধ হলে মিনি ক্যাম্পাস বানানোর দুর্নাম রটে। শিক্ষকদের একটি অংশের দাপট এবং কারও অধিকার হরণ থেকেই বিভাজনের সৃষ্টি হয়। সময়ান্তে গ্রুপে গ্রুপে দ্বন্দ্ব, শিক্ষক রাজনীতিতে ছাত্রদের জড়ানো আর মামলা-হামলা থেকেই কি শঙ্কার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না? সে জন্য শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামো বিনির্মাণ ও পরিবেশ তৈরিতে আগামী উপাচার্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন বলে আশা করি।

জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নিয়োজিত থেকে নিজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত উত্তরণের কাজটি তো শিক্ষকদেরই করতে হবে। তাদের ধারণ করতে হবে, শুধু নেই নেই বলে জ্ঞান সৃজন ও বিতরণে থেকে এগোনো যাবে না। যা আছে তা ব্যবহার করেও ব্যক্তি পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা অসম্ভব নয়। কম হলেও তো গত কয়েক বছরে কয়েকটি ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ হয়েছে। এখন শিক্ষক কেন, কর্মকর্তারা পর্যন্ত এয়ারকন্ডিশন গাড়িতে আসা-যাওয়া করছেন। যেখানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আগামী দিনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও উন্নয়ন হবে- এ প্রত্যাশা যুক্তিহীন নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন রীতিতে নীতিমালা প্রণয়ন ও পরিবর্তনে আইনি এবং মানবাধিকার বিষয়ে ভেটিং হয় না বলে এখানে ন্যায়পরায়ণতা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন পড়ে। তাই তো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার প্রজ্ঞাবান একজন উপাচার্যের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে।

সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032851696014404