সংবিধান আইনের সমতার কথা বলে। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান অধিকারভোগী। সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমান অধিকারের কথা বলে সংবিধান। বৈষম্য দূরীকরণে সংবিধানের আর্টিকেল ২৯-এর (খ)-তে বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবে না বা সেক্ষেত্রে তার সঙ্গে বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না। তবে ২৯-এর (গ)-তে বলা হয়েছে, নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা যাবে। এছাড়া কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে ওই ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান সংবলিত যে কোনো আইন কার্যকর করতে পারবে রাষ্ট্র।
এছাড়া আরও বলা হয়েছে, যে বিশেষ কর্মের প্রকৃতি নারী বা পুরুষের জন্য অনুপযোগী সেই কর্মের জন্য নারী ও পুরুষের পদ সংরক্ষণের ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকবে। সংবিধানের এ অনুচ্ছেদ থেকে কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আমাদের সামনে চিত্রিত হয়। দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে সরকারি কর্মে তাদের সুযোগ দেয়া উচিত। তবে সেই সুযোগ অবশ্যই সংখ্যার হিসাবে নয়। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মৌলিক সুযোগ নিশ্চিত না করে শুধু কর্মে সুযোগ দেয়ার জন্য বিশেষ রাস্তা তৈরি কি আহাম্মকি নয়? পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করলেই তো হয়।
একই শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা করে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে তারা যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে কর্মে জায়গা করে নিক। এ দৌড় প্রতিযোগিতায় সবাই একই সুবিধা নিয়ে পথ পাড়ি দিলেও একজন লালফিতা ছুঁয়েও প্রথম হতে পারল না, কারণ উচ্চতার মাপকাঠিতে অন্য কাউকে সুযোগ দিতে গিয়ে তাকে ছিটকে পড়তে হল।
এ কেমন নিয়ম? একজন ৯০ পেয়ে যা, আরেকজন ৭০ পেয়েও তাই? এটা কি বৈষম্য নয়? সংবিধানের আর্টিকেল ২৯ কি এতে ঠিক থাকল? প্রসঙ্গত, সদ্য প্রকাশিত ৩৮তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্যান্য কোটায় পদ আছে ১,০৩৪টি এবং মেধায় পদ রাখা হয়েছে ৯৯০টি, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সব মিলিয়ে ৫৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, শারীরিক প্রতিবন্ধীর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিদের জন্য রাখা হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি পদ! আর সাধারণ প্রতিযোগীদের জন্য ৪৫ শতাংশ। এই কোটা পদ্ধতি রাখার সুবাদে কোটাধারীরা কোনো রকমে প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই সোনার হরিণ তাদের হাতের মুঠোয়।
এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রায় প্রতি বছরই দেখা যায় কোটা নির্ধারিত পদ থেকে যায় শূন্য। যোগ্য ব্যক্তি না পাওয়ায় ওসব পদ খালি রাখা হয়। আবার নতুন করে পরবর্তী সার্কুলারে তাদের পদসংখ্যা যোগ করা হয়। এর ফলে তারা কখনই হতাশ হয় না। দেশের সূর্যসন্তানরা দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন।
অবশ্যই তারা নাতিপুতিদের চাকরির আশায় মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তবে কেন এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোটা? যেখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ও নারী কোটা মাত্র ১৫ শতাংশ, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কেন ৩০ শতাংশ? এটা কি ১০ শতাংশ রাখা যায় না? এতে করে সাধারণ প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে অনেক মেধাবীকে রাষ্ট্রীয় কর্মে যুক্ত করা যাবে। সময় হয়েছে কোটা পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবার। তা না হলে মেধাবীরা হতাশ হয়ে রাষ্ট্রের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে আজীবন।
শাহজাহান নবীন : প্রাবন্ধিক
সৌজন্যে:দৈনিক যুগান্তর