ছাত্রলীগের আসন–বাণিজ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ইডেন মহিলা কলেজে স্নাতক সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার আগে কলেজের আবাসিক হলে আসন পাওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে এই কলেজে পড়তে আসা অনেক মেয়ের পরিবার তাঁদের বাইরের হোস্টেল বা মেসে থাকতে দিতে রাজি নয়। এমন একজন শিক্ষার্থী পূর্বপরিচিত এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীর পরামর্শ ও সহযোগিতায় ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি আবাসিক হলে ওঠেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার প্রাচীন আর বড় এই কলেজের ছাত্রীনিবাসগুলোতে মূলত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আসন-বাণিজ্যের শিকার হয়ে আসছেন। এর বাইরে শিক্ষাজীবন শেষে অনেক শিক্ষার্থীও টাকার বিনিময়ে হলে থাকার সুযোগ নেন। তাঁদের কেউ কেউ মাসিক ভাড়াও দিয়ে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের কয়েকজন এই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন।

কলেজটিতে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে ছয়টি আবাসিক হলে আসনসংখ্যা ৩ হাজার ৩২০। কর্তৃপক্ষ বলছে, হলে কমবেশি ৭ হাজার শিক্ষার্থী থাকছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজিয়া হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের চারটি তলার মোট ৭৪টি কক্ষ কলেজের ছাত্রলীগ নেত্রীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এসব কক্ষ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ‘রাজনৈতিক কক্ষ’ নামে পরিচিত। রাজিয়া হলে ২২টি কক্ষে কমবেশি ৩৩০ জন ছাত্রী থাকেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের ৫২টি কক্ষে কমবেশি ৪০০ শিক্ষার্থী। নেত্রীরা বাদে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই টাকার বিনিময়ে এসব কক্ষে আসন নিয়েছেন। আনুমানিক হিসাবে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীপ্রতি ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ধরলে বছরে এসব কক্ষ থেকে কমপক্ষে ৮০ লাখ টাকার বাণিজ্য চলে।

জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ নিয়ে কিছুদিন আগে কলেজ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বসেছি। তখন জেনেছি, সবাই নয়, দু-একজন (আসন-বাণিজ্যের সঙ্গে) জড়িত। তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। তারপরও সিট-বাণিজ্যের কোনো অভিযোগ এলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ কলেজগুলোতে কমিটি করা হয়েছে সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষার্থে।’

গত কয়েক মাসে কলেজের বিভিন্ন বিভাগের কমপক্ষে ৮০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, শিক্ষার্থীর তুলনায় হলে আসন কম থাকার সুযোগ নেন নেত্রীরা। আবার শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও অনেকে অর্থের বিনিময়ে এসব রাজনৈতিক কক্ষে থাকার সুযোগ পান। এমনকি কিছু কিছু আসনে বহিরাগত ছাত্রীদের থাকার অভিযোগ রয়েছে। নেত্রীদের মাধ্যমে হলে ওঠায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে (মিটিং, মিছিল, সমাবেশ) যাওয়া বাধ্যতামূলক। এতে তাঁদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। কিন্তু হলে থাকতে হলে এসব মেনে নিতে হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজিয়া হল রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে সক্রিয়। ছাত্রলীগের নেত্রীদের বেশির ভাগই এই হলে থাকেন। পাঁচতলা এই হলের নিচতলা ও দোতলার ২২টি কক্ষের সব কটি ছাত্রলীগ নেত্রীদের দখলে। প্রতিটি কক্ষে চারটি বিছানায় আটজনের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এসব রাজনৈতিক কক্ষে কমপক্ষে ১৫ জন করে ছাত্রী থাকেন। কোনো কোনো কক্ষে আরও বেশি ছাত্রী থাকছেন। তবে পালাক্রমে বিছানা-মেঝেতে থাকার রুটিন এক দিন পরপর পরিবর্তন হয়।

*আসনপ্রতি ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়
*হল প্রশাসন বলছে, নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে ৫২টি রাজনৈতিক কক্ষ। এতে ছাত্রীর সংখ্যা কমবেশি ৪০০। গ্যাসের চুলা ও লিফটের সুবিধা থাকায় নতুন এই হলে ছাত্রীদের ওঠাতে ১৫-২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। চাহিদা বেশি হলে কারও কারও কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকাও নেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষক এবং বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, আসন-বাণিজ্যের পাশাপাশি নেত্রীদের ভয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকেন হলের সাধারণ ছাত্রীরা। ছোটখাটো অজুহাতে গালাগাল, এমনকি মারধরেরও শিকার হতে হয়। হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এ জন্য ছাত্রীরা কোনো অনিয়মের প্রতিবাদ করেন না। হল প্রশাসনও চুপ।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী ১৫ হাজার টাকা দিয়ে রাজিয়া হলে উঠেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রী হলে উঠেছেন ১৩ হাজার টাকা দিয়ে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা হলের এক ছাত্রী বলেন, গ্যাসের চুলার সুবিধা থাকায় হলে উঠতে তাঁকে ২৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষাজীবন শেষ হওয়া ছাত্রীরা মাসিক ২ হাজার টাকায় সিট ভাড়া দিয়ে হলে থাকেন বলে জানা গেছে।

কলেজের বাকি চারটি হলেও এমন বাণিজ্য হচ্ছে। তবে এসব হলে রাজনৈতিক প্রভাব কম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কলেজে ছাত্রলীগের দ্বিতীয় সারির নেত্রীরা আসন-বাণিজ্যে সরাসরি যুক্ত থাকেন। তবে এই অর্থ সংগঠনের প্রথম সারির নেত্রীদের কাছে জমা দিতে হয়। কলেজের শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাছলিমা আক্তার, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহনাজ আক্তার, মাহবুবা নাসরীন, নাসিমা আক্তার ও পাপিয়া প্রিয়ার বিরুদ্ধে আসন-বাণিজ্য নিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তাছলিমা আক্তার বলেন, ‘আগে কী হতো জানি না। নতুন কমিটি হওয়ার পর স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, কলেজে আসন-বাণিজ্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে।’ তিনি এসবের সঙ্গে জড়িত নন উল্লেখ করে বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ জানালে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তাঁর নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন হলে ২০টি কক্ষ থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি তো গুনিনি। এর কমও হতে পারে, বেশিও হতে পারে।’

বাকি নেত্রীদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘আমরা রেফারেন্সে ছাত্রীদের হলে ওঠাই। পরে লিগ্যাল করে নিই। যাঁরা আমাদের কাছে পাঠান, তাঁরা হয়তো এই টাকাটা নেন। তবে এত টাকা নেওয়ার কথা না। কেউ হয়তো ১-২ হাজার টাকা নেন।’ যুগ্ম আহ্বায়ক নাসিমা আক্তার বলেন, ছয়টি হলে তাঁদের অধীনে ৫০০ থেকে ৬০০ রাজনৈতিক কর্মী আছেন।

২০১৬ সালের ১ নভেম্বর ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়। এর আগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রেহেনা তাসনীম মুঠোফোনে বলেন, ‘সবাই টাকা নেয় না। কেউ হয়তো নেয়। আর যারা পলিটিকস করবে, মিটিং-মিছিলে যাবে, তাদেরই পলিটিক্যাল রুমে ওঠানো হয়।’

রাজিয়া হলের প্রভোস্ট কামরুন নাহারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। এসব বিষয়ে তিনি অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের প্রভোস্ট শামসুন নাহার বলেন, ‘এ ধরনের তথ্য আমার জানা নেই।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ শামসুন নাহার বলেন, ‘স্নাতকোত্তর পরীক্ষা হতে দেরি হওয়ায় এবার হলে আসন বরাদ্দ দিতে দেরি হচ্ছে। তবে হলে টাকার বিনিময়ে আসন দেওয়ার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। অবৈধ মেয়ে নয়, কোনো মেয়ের হয়তো বন্ধুটন্ধু হলে থাকতে পারে। হল প্রশাসন তৎপর। হল নিয়ন্ত্রণে আছে।’

ইডেন কলেজে আবাসিক হলের আসন নিয়ে বাণিজ্যের বিষয়টি অনেক দিন ধরে চলে আসছে। আগের সরকারের সময় ছাত্রদলের নেত্রীদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। তবে এখন বাণিজ্যের পরিধি বেড়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, দেশে নারী শিক্ষার বিষয়ে মেয়েদের ও পরিবারের আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পরে ভর্তি এবং আসন-বাণিজ্য নিয়ে প্রথমে হোঁচট খেতে হয়। এমনকি ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজেও আসন-বাণিজ্যের চিত্র ভয়াবহ। এটা বহমান। যে সরকারই আসুক না কেন, তার ছাত্রসংগঠন সুযোগটি নেয়। এটা অভিভাবকদের উদ্বেগ এবং শিক্ষার্থীদের কষ্টের বিষয়। কিন্তু আসন-বাণিজ্য বন্ধে কর্তৃপক্ষের প্রয়াস নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি নেই। নারী শিক্ষার অর্জন ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আসন-বাণিজ্য বন্ধের দায়িত্ব নিতে হবে।

সূত্র: প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040831565856934