স্কুলের বই-পুস্তকে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির যে সোনালি অধ্যায়টির সাথে পরিচয় ঘটে, কলেজে গিয়ে বুঝতে পারলাম মরিচা ধরে তার সোনালি বর্ণটা তামাটে হয়ে গেছে। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রে ছাত্র সমাজের ভূমিকা স্কুলজীবনে আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করতো। বড় হয়ে ছাত্র রাজনীতি করার একটি স্বপ্ন লালন করতাম। মাধ্যমিক শেষ করে উচ্চ-মাধ্যমিকে ভর্তি হই স্বনামখ্যাত সিলেটের এম. সি কলেজে। কলেজের প্রথম দিনেই এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই যা আগে কখনও কল্পনাও করতে পারিনি। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে আমাদেরকে অভিনন্দন জানাতে এসে রাজনীতিবিদ ভাইয়েরা আমাদের সামনেই মারামারি শুরু করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নানাজাতের অস্ত্রের ঝনঝনানি আর উত্তেজক স্লোগানে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে উঠল। কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্রও গর্জে উঠল। কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে মেসে ফিরলাম। দুইদিন পরেই কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাসটি পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কলেজের দুই বছরে ছাত্র রাজনীতির এমন অসংখ্য পারফর্মেন্স (!) খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তাছাড়া প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিংসতার খবর আমাকে খুবই উদ্বিগ্ন করতো। যার ফলে আমি রীতিমতো ছাত্র রাজনীতি বিদ্বেষী হয়ে উঠি। সে সময়ে আমাদের স্কুলের পুনর্মিলনীর ম্যাগাজিনে ‘আদর্শ ছাত্র রাজনীতি দেশের জন্য আশীর্বাদ, লাগামহীন হলে অভিশাপ’ শিরোনামে একটি লেখায় আমার ভেতরের সব ক্ষোভ ঢেলেছিলাম। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন এমন একজন সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান তখন আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। কারণ, আমার কাছে ছাত্র রাজনীতি এতোটাই কুিসত মনে হত যে, আমি ভাবতাম এ আপদ দূর না হলে দেশ রসাতলে যাবে।
কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও ছাত্র রাজনীতির বিকৃত পরিবেশটিই পেয়েছি। তবে এখন এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা অনেক বদলে গেছে। আগে মনে করতাম ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এখন ছাত্র রাজনীতির সেই আদর্শ, সেই সোনালি দিনগুলো আবারো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখি। এদেশের প্রতিটি মানুষের ভাগ্য রাজনীতির ভালো-মন্দের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। আমরা চাইলেই এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবো না। এমতাবস্থায়, সত্, আদর্শ চরিত্রবান, মেধাবী ছাত্ররা যদি রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায় তাহলে বিদ্যমান অবস্থাটি আরও নাজুক হবে।
রাজনীতির মাঠ চলে যাবে সন্ত্রাসী গ্যাংদের হাতে। অদূর ভবিষ্যতেই আমাদের রাজনীতিতে যোগ্য নেতৃত্বের সংকট তৈরি হবে। সুতরাং, বর্তমান ছাত্র রাজনীতির অত্যধিক নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে যারা যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করেন, দেশ ও জাতির বৃহত্ স্বার্থেই তাদের এগিয়ে আসা উচিত। আমি বিশ্বাস করি, আমরা ইচ্ছা করলেই আমাদের ছাত্র রাজনীতির পূর্ব ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে আমাদের বৃহত্ ছাত্র সমাজকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করতে পারব।
এক্ষেত্রে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। ছাত্র হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত এসব বিষয়ে একটু সচেতন হলেই আমরা প্রচলিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে পারব। বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে মেধাবী ছাত্ররা দিন দিন ঐতিহ্যবাহী সংগঠনগুলো থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। আর এ সুযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে দেশদ্রোহী ও জঙ্গি সংগঠনগুলো। আসুন আমরা সবাই মিলে দেশের স্বার্থে, ছাত্র সমাজকে বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষার স্বার্থে দেশে সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির পরিবেশ গড়ে তুলি।
লেখক :শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট