ছয়শ খাতায় নয়ছয়, আজীবন কালোতালিকায় পরীক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক |

মূল্যায়ন না করেই বিজ্ঞানের ৬০০ খাতায় মনগড়া নম্বর দিয়েছেন ময়মনসিংহের এক শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৮ জন বোর্ডের খাতা চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু কারও ফল পরিবর্তন হয়নি। পুরো বিষয়টি রহস্যের জন্ম দেয়ায় স্কুল কর্তৃপক্ষ অধিকতর তদন্তের জন্য বোর্ডে আবেদন করে। আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত করতে গিয়ে এ মহাকেলেঙ্কারির প্রমাণ পায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। চ্যালেঞ্জ করা সেই ১৮টি খাতাও অন্য আরেক জনকে দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করিয়েছে অভিযুক্ত পরীক্ষক। অনৈতিক এ কজের দায়ে ইতিমধ্যে দুইজন পরীক্ষককে বোর্ডের সকল কার্যত্রুম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে আজীবনের জন্য।

অপরদিকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও শাস্তি নিশ্চিত করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে জানাতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গত ৬ই জুলাই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সালমা জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ নির্দেশ দেয়া হয়। আর এসএসসি পরীক্ষায় এমসিকিউ এর উত্তরপত্র পরিবর্তন করে একজন শিক্ষার্থী ৩ বিষয়ে ফেল করানোর ঘটনা অন্য আরেকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে একই চিঠিতে। দু’টি ঘটনাই ঘটেছে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায়। এ ধরনের গর্হিত কাজের জন্য গত এক সপ্তাহে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ১০টির বেশি কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করেছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার  বলেন, দুইজন শিক্ষককে বোর্ডের সকল কার্যত্রুম থেকে অব্যাহতির পাশাপাশি সারা জীবনের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি। তিনি বলেন, যারা পাবলিক পরীক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবহেলা করেন তাদের কোন ছাড় দেয়া হবে না। মাউশির মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, মহাপরিচালকের ডেস্ক থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পেয়েছি। তাদের অভিযোগের ধরন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পাশাপাাশি তাদের এমপিও স্থগিত করা হবে।

বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় এ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। পুরো বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে অবাক হয়ে যান বোর্ডের তদন্ত কর্মকর্তারা। অভিযুক্তদের কাছ থেকে পুরো ঘটনার লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেছে তদন্ত কমিটি।

সেই তদন্ত রিপোর্ট ও লিখিত বক্তব্যের সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ শহরে মহাকালী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক (বিজ্ঞান) ইসরাত পারভীনকে জেএসসি বিজ্ঞানের ৬০০ খাতা দেয়া হয়। সেই খাতা তিনি নিজে মূল্যায়ন না করেই মনগড়া ওএমআর নম্বর বসিয়ে দেন। তার এ কাজে সহযোগিতা করেছে তার নিরীক্ষক রফিকুল ইসলাম ও শরীর চর্চা শিক্ষক মালেকা পারভীন। তবে দুইজনেই তদন্ত কমিটির কাছে খাতা মূল্যায়নের সঙ্গে যুক্ত না থাকার কথা জানিয়েছেন। এরমধ্যে মালেকা পারভীন জানান, ইসরাত পারভীন কোনো খাতায় মূল্যায়ন না করেই অনুমানের ভিত্তিতে ওএমআর এ নম্বর বসিয়ে দিয়েছেন। আর রফিকুল ইসলাম মালেকা পারভীনকে দিয়ে খাতা মূল্যায়নের কথা বলেছেন।

তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে অভিযোগ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। তদন্ত কমিটি জিজ্ঞাসাবাদে ইসরাত পারভীন লিখিতভাবে জানান, তিনি নিজে কিছু খাতা মূল্যায়ন করেছেন অবশিষ্ট খাতা তার নিরীক্ষক রফিকুল ইসলামকে দিয়ে মূল্যায়ন করিয়েছেন। আর প্রধান পরীক্ষক ফজলুল হক তদন্ত কমিটিকে জানান, ইসরাত পারভীন ৬০০ খাতা জমা না দিয়ে অর্থাৎ খাতা তার নিজের বাসায় রেখে শুধু ৬০০টি ওএমআর দেন এবং ১৮টি পুনঃনিরীক্ষণে উত্তরপত্র ঢাকা বোর্ডের পাঠানোর জন্য তার নিকট জমা দেন। আর তার নিরীক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, ইসরাত পারভীন প্রাপ্ত উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেননি। তিনি তার সহকর্মী শরীর চর্চার শিক্ষক মালেকা পারভীনকে দিয়ে কিছু খাতা মূল্যায়ন করিয়েছেন। আর মালেকা পারভীন জানান, ইসরাত পারভীন ৬০০ খাতা মূল্যায়ন না করেই ওএমআর এর মধ্যে শুধু প্রাপ্ত নম্বর বসিয়ে বোর্ডে পাঠিয়ে দেন। তিনি আরও জানান, পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আসা ১৮টি খাতা আগের ওএমআর প্রাপ্ত নম্বর মিলিয়ে এমসিকিউ-এর সঙ্গে সিকিউ নম্বর সমন্বয় করে দেয়ার কাজটি তিনি করেছেন। তিনি কোনো খাতা মূল্যায়ন করেনি বলে তদন্ত কমিটিকে লিখিতভাবে জানান।

পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি মতামত দেন, পরীক্ষক ইসরাত পারভীন কোনো খাতা মূল্যায়ন না করেই উত্তরপত্রে সিকিউ এবং এমসিকিউ উভয় অংশে অনুমানের ভিত্তি করে ওএমআর এ নম্বর দেন। পুনঃনিরীক্ষণের জন্য ১৮টি খাতা বাদে বাকি ৫৮২টি খাতা জব্দ করে যাচাই-বাছাই করেও এর প্রমাণ মিলেছে। এই পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ন না করেই নম্বর দেয়া চরম অনৈতিক, দায়িত্বহীন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে মতামত দেয় তদন্ত কমিটি। একই সঙ্গে প্রধান পরীক্ষক মূল খাতা না নিয়ে শুধু ওএমআর নিয়ে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন এবং ইসরাত পারভীনের এহেন কাজের সহযোগিতা করেছেন। প্রধান পরীক্ষক এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি বোর্ডকে জানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটি করেননি। এজন্য তারও শাস্তি হওয়ার উচিত। তবে প্রধান শিক্ষককে এই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিলেও ছাড় পাননি নিরীক্ষক ত্রিশালের রওশন আর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফজলুল হক।

এ ব্যাপারে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী একজন পরীক্ষককে আমরা সাধারণত ৩০০ খাতা দিয়ে থাকি। কিন্তু অনেক সময় বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষক কম থাকায় এর বেশি দিতে হয়। আর জেএসসিতে খাতা বেশি থাকায় ৩০০ অধিক খাতা দিতে হয়। তবে কোর্টের রায়ে পর আমরা ৩০০ বেশি খাতা কাউকে দিচ্ছি না। একই সঙ্গে এই ৩০০ খাতা মূল্যায়নের জন্য ১২ দিনের জায়গায় ১৫দিন সময় দিচ্ছি। আর বাধ্য হয়ে কাউকে অতিরিক্ত খাতা দিলে সেই অনুযায়ী সময় দিচ্ছি। এরপরও যদি কেউ খাতা মূল্যায়নে অবহেলা করে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই শাস্তি নেয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029449462890625