জাগরণের বিস্মরণ প্রসঙ্গ ১২ নভেম্বর

গোলাম কবির |

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বিষম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস পূর্ববাংলা বিশেষ করে দক্ষিণ বাংলার মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। তখনকার পাকিস্তানি শাসকমহলের ঔদাসীন্যের কারণে ঘূর্ণিঝড়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি এ দেশের ভুক্তভোগী মানুষের চেতনায় মুক্তির সাড়া জাগিয়েছিল নিবিড়ভাবে।

তাঁরা এক হয়েছিলেন।
সাধারণত দেখা যায়, দুর্যোগের দুঃসহ দিনে মানুষ আপাত-বিরোধ ভুলে গিয়ে এক হয়। অবশ্য বাংলার মানুষের সেই এক হওয়া এক দিনেই ঘটেনি। দেশভাগের পর বঞ্চনার শিকার এ দেশের মানুষ ধীরে ধীরে এক হতে থাকে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুবশাহি ধসে পড়েন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ইতিহাসে ক্রূর হিসেবে পরিচিত জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি সত্তরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধি ছিল তারা ছলে-বলে কলে-কৌশলে আবার ক্ষমতার মসনদে আসীন হবে। কিন্তু দেশাত্মবোধের মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্যোগকবলিত মানুষের প্রতি পাকিস্তান সরকারের চরম অবহেলা প্রত্যক্ষ করে বাঙালির স্বার্থের পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় দেয়।

বলা হয়ে থাকে, ধ্বংসের মাঝেই নতুন সৃষ্টির বীজ উপ্ত থাকে। দীর্ঘকালের পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলার প্রথম পরিশীলিত পদক্ষেপ ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচন। আর এই পদক্ষেপকে বাইরে থেকে ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করেছিল ১২ নভেম্বরের প্রবল সাইক্লোন। ফলে দিকে দিকে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। বঞ্চনাহীন নতুন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল বাঙালি।
সত্তরের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের রুদ্ররোষের পর একাত্তরের চাপিয়ে দেওয়া অসম যুদ্ধে লাখো প্রাণ আর সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি স্বাধীনতা পেল। বলা হয়ে থাকে, মানুষ মননের দিক থেকে নাকি চল্লিশ বছরে পূর্ণতা লাভ করে। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার বয়স সে সময় পার করেছে।

সত্তরের ১২ নভেম্বরোত্তর আমাদের মাঝে যে নবজাগৃতির শিখা প্রজ্বলিত হয়েছিল, তা নিষ্প্রভ হতে চলেছে অর্ধশতাব্দী পার না হতেই। হীনস্বার্থের দ্বন্দ্বে এবং পদ-পদবি, বিত্তবৈভব আর প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে আমরা বিচ্ছিন্ন। কোরআনে একত্র থাকার নির্দেশ ও উপনিষদের ঋষিদের এক হওয়ার উপদেশ উপেক্ষিত রয়ে গেল। জাতির ভবিষ্যৎ বাদ দিয়ে ব্যক্তির আখের গোছানোর তালে আমরা অবরুদ্ধ।

নানা কারণে সমাজ ও জীবনে মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে জগৎ জোড়া। সেখান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন নই। ফলে তাত্ক্ষণিকভাবে আমরা সংক্রমিত হচ্ছি। আর এই সংক্রমণ গ্রাস করেছে শিক্ষা ও দেশ চালনার প্রতিটি অঙ্গনকে। যে যেখানে আছি, সেখানেই দুর্নীতি আর লুটপাটের অভয়রাজত্ব কায়েম করছি। সর্বাঙ্গে ব্যথা মলম লাগানো যাবে কোথায়!

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে অগ্রবর্তীদের কর্মকাণ্ড পরবর্তীদের চেতনাকে গ্রাস করে। আর সে কর্মকাণ্ড যদি দোষদুষ্ট হয়, তবে তা সর্বগ্রাসী রূপ নেয়। কেননা কোনো কোনো ব্যাধি ভয়াবহ সংক্রামক। একদা শিক্ষকরা ছিলেন নির্মোহ। তাঁরাই ছিলেন শিক্ষার প্রধান যাজক। এখনো। তবে পার্থক্য হলো, এখন তাঁরা অনেকে পদ-পদবি আর উচ্ছিষ্টের লোভে নীতি-আদর্শ বিসর্জন দেন এবং বহুধাবিভক্ত হন। এ অবস্থায় তাঁদের অনুসারীরা বিভ্রান্তির পথ বেছে নেবে, এতে বিস্ময়ের কী আছে?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশের প্রায় সর্বত্র যে নৈরাজ্যের হাট বসছে, তার প্রতিবাদ করার নৈতিক দায়িত্ব শিক্ষকদের হাতে আর থাকছে না। শিক্ষক হবেন রাজহংসের মতো, তিনি গ্রীবা উন্নত করে চলবেন, বাইরের আবিলতার পঙ্ক তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। এখন করছে। কারণ নির্ধারিত কর্মযোগ শেষে আবার তাঁরা সনদ বিক্রির কারখানা খুলছেন। সেখান থেকে সম্পদ ক্রেতারা কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতায় বাজারে টিকছে না। কেমন করে টিকবে? তাদের অনেক গুরুই তোষামোদ আর আত্মীতার বাঁকা পথ ধরে বড় বড় আসন কবজা করেছেন। প্রতিযোগিতা কী, তা জানেন না। শোনা যায়, দেশের ৩১৫টি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের মধ্যে ২২২ অধ্যক্ষই সরকারি করুণাপ্রাপ্ত। কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ না করেই মাথার ওপর বসে আছেন। মরমি কবি জালাল উদ্দিন রুমি অনাগত দিনে এমন অবস্থার কথা কল্পনা করে তাঁর ‘মসনবী’তে লিখেছেন, এমন সময় আসবে, যখন প্রকৃত জ্ঞানীরা চারপাশের অনিয়ম দেখে অশ্রু বিসর্জন করবেন। আর অধমরা তাঁদের কাঁধে উঠে নিয়ত নৃত্য করবে। বোধকরি আমরা সেই সময় অতিক্রম করছি। তাই আমাদের দেশ গড়ার জন্য ভবিষ্যতের তরুণরা স্বচ্ছ মুক্তির পথ দেখছেন। তাঁরা আত্মঘাতী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সত্তরের ১২ নভেম্বরের ধ্বংসযজ্ঞের পর দেশের ছাত্র-জনতার চেতনায় যে দুর্মর আশার আলো জ্বলে উঠেছিল তার পুরোধা ছিলেন বঙ্গবন্ধু, হাতে ছিল তাঁর মুক্তির মশাল। সে আলো আমরা নিজেদের আখের গোছানোর কর্মদোষে নিষ্প্রভ করে ফেলেছি। সেবার নামে টাকা ধরার ফাঁদ পেতে বসেছি অনেকে। ছোটখাটো চাকরি পেতেও নাকি টাকা গুনতে হয় বলে শোনা যায়। শিক্ষকতায় নিয়োগ কর্তৃপক্ষকে খুশি করতে হয়। তাঁরা উন্নয়নের নামে নিজের পকেট ভারী করেন। টাকা দিলেই যোগ্যতার প্রশ্ন থাকে না। তা ছাড়া আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে তো পাথর সোনা হয়ে যায়। এত সব নৈরাজ্য তরুণদের হতাশ করছে। তারা শিক্ষক ও অগ্রজদের লেজুড়বৃত্তি দেখে কী শিখবে? শিখবে অবৈধ ক্ষমতার বলে প্রতিপত্তি হাতিয়ে নেওয়ার অন্ধকার পথ।

১২ নভেম্বর পরবর্তী উদ্দীপনা ও জাগরণ সমান্তরাল চলতে থাকবে, এমনটা হয়ে ওঠে না। এটা প্রাকৃতিক নিয়মও বটে। তাই বলে জাতির বেশির ভাগ মানুষের উন্নয়ন ও মুক্তি এবং যোগ্য ব্যক্তিদের মূল্যায়নের অনুভূতি যদি শুকিয়ে যায়, তবে জাতীয় জাগরণ জাতীয় মরণের দিকে ধাবিত হবে। এটা চলতে দেওয়া যায় না। এ জন্য প্রথমেই শিক্ষকসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সভ্যতার ইতিহাস বলছে একদা রাজনীতিকদের সুপরামর্শক ছিলেন সুশিক্ষকরা। এখন উল্টো, শিক্ষকরাই রাজনীতিক ও ক্ষমতাবান ছাত্রদের দ্বারে উমেদার হন। কবি জীবনানন্দ দাশ যাকে বলেছেন ‘অদ্ভুত আঁধার’। কার্যকর শিক্ষার মাধ্যমে এ অন্ধকার ঘোচাতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষা ও দেশ নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁরাই হয়তো ঘোচাতে পারেন অন্ধত্ব এবং নতুন করে পুষ্পিত জাগরণ আনতে।

লেখক : সাবেক অধ্যাপক, রাজশাহী কলেজ

 সূত্র: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022799968719482