নতুন জাতীয়কৃত ও ভবিষ্যতে জাতীয়করণের যোগ্য কলেজসমূহের শিক্ষকদের জন্য একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছেন বি সি এস সাধারণ শিক্ষক সমিতি। এরকম প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির আলাদা তিনটি সংবাদ দেখলাম দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র অনলাইন জাতীয় পত্রিকা দৈনিক শিক্ষায় (www.dainikshiksha.com)। পড়ে চমকে গেলাম। সেই পুরানো রের্কড আবারো বাজাতে শুরু করেছেন তাঁরা। প্রথমে মনে করেছিলাম সরকার বা মন্ত্রণালয় এই গুরু দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদের। তবে, খবর পড়ে দেখলাম তা নয়। গায়ে পড়ে কথিত নীতিমালা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠিয়েছেন সমিতি নেতৃবৃন্দ। এখন তাঁরা এসব বাস্তবায়নের জন্য দাবি জানাচ্ছেন।
তাঁদের তৈরি নীতিমালা সর্ম্পকে আমার কয়েকটি ব্যক্তিগত জিজ্ঞাসা রয়েছে। তাঁদের দায়িত্ব না দিলেও তাঁরা কেন গায়ে পড়ে নীতিমালা তৈরি করেছেন? তারা তো বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁরা নিজেদের মহাজ্ঞানী ভাবছেন তাতে সন্দেহ নেই। এই নীতিমালা তৈরিতে সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁদের চেয়ে নিজেদের অভিজ্ঞ ভাবছেন কিংবা তাঁদের (সরকার যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন) অযোগ্য মনে করছেন। তা না হলে কেন এমনটি করতে যাবেন তাঁরা?
ইতিপূর্বে একাধিকবার লেখালেখি হয়েছে তাঁদের মানসিকতা নিয়ে। আমি নতুন করে বলার প্রয়োজনও মনে করছি না এসব বিষয়ে। তবে, ক্যাডার সার্ভিসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কোনো প্রার্থী পছন্দের প্রথম বা দ্বিতীয় তালিকায় রাখেন না, সবশেষ তালিকাতেই রাখেন। যাঁরা আজ নিজেদের ক্যাডার বলতে অজ্ঞান হচ্ছেন তাঁরাও শিক্ষাক্যাডার পছন্দের তালিকায় সবশেষে রেখেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হয়ত আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন না। পিএসসিতে কীভাবে নিয়োগ হয়েছে বিগত কয়েকবছরে তাও আমরা জানতে পারি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
তাঁরা জাতীয়কৃত কলেজের শিক্ষকদের বদলী সংক্রান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। আবার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সরাসরি বিরোধীতাও করছেন। নিজেদের অনুকূলে গেলে সেটা সঠিক আর স্বার্থ উদ্ধার না হলে তা ঠিক নয়! কতিপয় বি সি এস শিক্ষাক্যাডারদের দাবি এমনটিই। আত্তীকৃত শিক্ষকদের মর্যাদাহানি করে নিজেদের উচ্চ মর্যাদার আসনে উপবিষ্ট করা তাঁদের মূল লক্ষ্য বলে মনে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করার ঘোষণা ও প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের শুরু থেকে তাঁরা বিরোধীতা করে আসছেন। তাঁরা কখনো চাননি প্রধানমন্ত্রীর এই ঐতিহাসিক ও সাহসিকতার ঘোষণার বাস্তবায়ন। একের পর এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে যাচ্ছেন কতিপয় ক্যাডার কর্মকর্তা। আদালতেও গিয়েছেন। আপনাদের যদি রাষ্ট্র, আদালত ও সরকারের প্রতি ভরসা ও আস্থা থাকে তাহলে কেন এসব খসড়া নীতিমালা। আদালত যে আদেশ দিয়েছেন তা মানা কী উচিত নয়?
তাঁরা কি কখনো ভেবে দেখেছেন তাঁদের শেকড় কোথায়? জাতীয়কৃত কলেজের চেয়ারে বসেই এমন বিরোধীতা করছেন। সেখানে থেকে তাঁদের রুটি রোজগার হচ্ছে। যদি বিভিন্ন সময়ে ওইসব কলেজ জাতীয়করণ না হতো তাহলে কি তাঁদের পদ সৃষ্টি হতো? এমনও ক্যাডার রয়েছে যাদের মোট জনবল দুইশ। যদি কলেজ জাতীয়করণ না হতো তাহলে শিক্ষা ক্যাডারের অবস্থাও তা-ই হতো। আর সংখ্যা যদি এমন হতো তাহলে তাঁরা কি পারতেন এমন আওয়াজ তুলতে? যদি আপনাদের দাবি বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে কী চেয়ারটি থাকবে, বিষয়টি একবারও ভেবে দেখেছেন তাঁরা। আত্তীকৃত শিক্ষকদের মর্যাদা না দিলে হয়ত তাঁরা সুবোধ বালকের মতো বসে থাকবেন না। তাঁদের মধ্যেও শুরু হবে মোচড়।
নিজেদের কাঙ্খিত ও পাওনাটুকু আদায় করতে হয়ত ছুটবেন আদালতে। যদি আগের জাতীয়কৃত কলেজের শিক্ষকেরা ক্যাডার হন, তাহলে এখন যেসব কলেজের জাতীয়করণ হচ্ছে ওইসব কলেজের আত্তীকৃত শিক্ষকেরা কেন হবেন না? বি সি এস সাধারণ শিক্ষা সমিতির প্রস্তাবিত নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হলে আগের শিক্ষকদের (যাঁরা জাতীয়করণের পর ক্যাডার মর্যাদা পেয়েছেন) ননক্যাডার ঘোষণা করতে হবে, ওই পদে থেকে এতোদিন যেসব সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন তা সরকারকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এটাইতো স্বাভাবিক ও নিয়মের বৃত্তে আবৃত বিধান। তাহলে এটা কি সম্ভব? ক্যাডার সদস্যরা কী মানবেন এই বিধান?
তবে বিসিএস ক্যাডারেরা অনেক ধাপ অতিক্রম করে, চরম প্রতিযোগিতা করে নিজের জায়গাটি পেয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে কোনো বিরোধিতা বা দ্বিমত পোষণ করছি না, এই সাহসও নেই। তবে জাতীয়কৃত কলেজেও রয়েছে অনেক মেধাবীমুখ। যাঁদের অনেকেই বি সি এস এর মৌখিক পরীক্ষা পর্যন্ত পৌঁছেছেন। তবে আপনাদের মতো পছন্দের শেষ তালিকায় শিক্ষা না রাখায় চাকরি জোটেনি। অথবা তদবির করাতে পারেনি। ওইসব কলেজে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকেরা পাঠদান করান তার প্রমাণ পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল। সরকারি কলেজের সঙ্গে ওইসব কলেজের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল তুলনা করে দেখলে একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
তাঁদের রূপকল্পের নীতিমালায় কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ ধারা রয়েছে নিজেদের সুবিধার জন্য। তবে কিছু ধারায় তাঁরা যৌক্তিক বিষয়ের অবতারণ করেছেন আর কিছু ধারা রয়েছে তাঁদের হাতিয়ার। এই হাতিয়ার ব্যবহার করে সহজে ফেলা যাবে ষড়যন্ত্রের শিকার আত্তীকৃত শিক্ষকদের।
আমি তাঁদের নীতিমালার অনেক ধারার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করছি। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মত। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে যেসব বিষয় জড়িত তা অবশ্যই মানতে হবে। যোগ্যতা না থাকার পরেও ক্যাডার হওয়া এটা যেমন বেমানান তেমনি অমানবিকও বটে। আমি চাই যোগ্য শিক্ষকদেরই মর্যাদা দেওয়া হোক। এক্ষেত্রে তাঁদের নতুন কিছু প্রস্তাবনা আসা উচিত ছিল। তবে সেরকম কিছু আসেনি বলে মনে হয়।
সদ্য জাতীয়করণ হওয়া এবং এর প্রক্রিয়ায় থাকা কলেজগুলো নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য পরিমান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই যুগান্তকারী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে সেটা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানানো উচিত উভয় পক্ষকে। ক্যাডার, ননক্যাডার, সরকারি শিক্ষক, বেসরকারি শিক্ষক, কনিষ্ঠ আর জ্যেষ্ঠর বির্তকে না জড়িয়ে নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় সজাগ হলেই সার্থকতা আসবে।
যবনিকায় এসে স্ববিরোধী দুটি কথাও বলতে চাই। বি সি এস সাধারণ শিক্ষক সমিতি যে নীতিমালা দিয়েছেন অপরদিকে জাতীয়কৃত এবং এর প্রক্রিয়ায় থাকা কলেজসমূহের শিক্ষকদের সংগঠনের পক্ষেও দাবি সম্বলিত একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত (হয়ত পাঠানো হয়ে থাকতে পারে)।
উভয়ের প্রস্তাবনা থেকে আইনের মধ্যে থেকে একটি সুন্দর ও উভয়ের মর্যাদা রক্ষার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরী।
মামুনুর রশিদ মামুন: সাংবাদিক, প্রথম আলো, বাগমারা, রাজশাহী।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]