জাতীয়কৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদায়নে চরম অনিয়ম

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

অনিয়মের মধ্য দিয়ে কোন রকমে চলছে প্রাথমিক শিক্ষা। নিয়মের মাঝে চলার জন্য তেমন কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্বে পদায়ন শুরু হয়েছে।

৩০ বছর যাবৎ সহকারি শিক্ষক হিসেবে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা থাকা সত্বেও আজ বহু অভিজ্ঞ শিক্ষক পদোন্নতি বঞ্চিত। এজন্য শিক্ষকদের মধ্যে যেমন চরম হতাশা বিরাজ করছে তার পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষকের পদ খালি থাকায় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় অচলবস্থা বিরাজ করছে। আবার শিক্ষক সংকটে ক্লাস পরিচালনা করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। তীব্র সংকটের মাঝে পাঠদান বহির্ভূত কাজের চাপে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ আজ দিশেহারা।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতির ক্ষেত্রে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন সহকারি শিক্ষককে সাত বছর অভিজ্ঞতা অর্জন করার বিধান রয়েছে। সদ্য জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়সমূহে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতার ঘাটতির কারণে ওই সমস্ত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কেই যেন পদায়ন করতে না পারে এবং পদটি যেন দীর্ঘ সময় খালিই থাকে সেই জন্যে কেউ কেউ রিট পিটিশনের আশ্রয় নিচ্ছে শুধুমাত্র প্রধান শিক্ষকের ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বটি পালনের সুযোগ পেতে।

এ প্রসঙ্গে নোয়াখালির সুবর্ণচরের চিত্র তুলে ধরা যায়। এ ধরনের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ১১ নং মধ্যম চর ব্যাগ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯ নং দক্ষিণ চর ব্যাগ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪ নং মধ্যম চর ব্যাগ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,২৪ নং দক্ষিণ চর ব্যাগ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫ নং মধ্যম চর ব্যাগ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিম জাহাজমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ( ১), সেলিম চেয়ারম্যান বাজার আশ্রায়ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর মহি উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জনতা বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (২) ও চর জুবিলী অজিফা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

অন্যদিকে উপজেলার সদ্য জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদে পদোন্নতি নেয়ার ক্ষেত্রে ৬ জন শিক্ষক কাঙ্ক্ষিক যোগ্যতা না থাকার পরও এমপিওভুক্তির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকের স্কেলপ্রাপ্ত হয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে গেজেটভুক্ত হন। তারা প্রধান শিক্ষকের বেতনগ্রেডে দুইটি টাইমস্কেলও পরিগ্রহ করছেন। যদিও জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়ে পদোন্নতির সুযোগ নাই তার পরেও ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর ও ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের জুনে টাইমস্কেল পরিগ্রহ করেন তারা। এছাড়া তাদের এসএসসি ও এইচএসসিতে রয়েছে ৩য় বিভাগ।

এসব শিক্ষকের তালিকায় রয়েছেন উত্তর চর রশিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কাশেম, পানা উল্যাহ সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক মোঃ জসীম উদ্দিন, নোয়াপাড়া এমএস রেড়ক্রিসেন্ট সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক মোঃ নুরুল আলম, চরকাজী মোখলেছ সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক মোঃ আবদুল গফর, মনাববিয়া সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক মোঃ মোতাহের হোসেন, ভুইয়ার হাট এমএ কামাল সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক মোঃ আবদুল আজিজ।

এছাড়া কাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সুবর্ণচর উপজেলার হারুনুর রশীদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক টিটু চন্দ্র দাস ও মধ্য নয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব বকুল চন্দ্র শীল বিধিবহির্ভুতভাবে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বেতন ভাতা পেয়ে আসছেন। কেবল মাত্র স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে তাদের। এছাড়া কোন ধরনের এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে বা সরকারি বিদ্যালয়ের ৩ বছরের কাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। এভাবে সরাসরি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ ২০১২ সালে এমপিওভুক্তির সুবাদে রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের সকল সার্কুলার ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ১৯৯১ এর সরাসরি লংঘন।

এছাড়া উপজেলার সদ্য জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ জন ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাইয়ের পর সৃজন হওয়া পদে স্কেল সুবিধা পাওয়া প্রধান শিক্ষকগণ টাইমস্কেলের প্রচলিত বিধি নিষেধ ভঙ্গ করে ২ থেকে ৩টা টাইম স্কেল গ্রহণ করে বেতন ভাতা নিচ্ছেন। প্রত্যেকে প্রতিমাসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে সরকারের অতিরিক্ত অর্থ নিচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, ফরিদপুর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সদ্য জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়সমূহের প্রধান শিক্ষকগণকে টাইমস্কেল প্রদান সম্পর্কিত নির্দেশনা কামনা করেন। এর প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২রা আগস্টের এক নির্দেশনাতে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, যেহেতু প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকের বেতনস্কেল আলাদা সেহেতু টাইমস্কেল সুবিধার জন্যে দুই পদকে একই স্কেলভুক্ত পদ হিসেবে গণনা করা যাবে না। এ সিদ্ধান্তে সিজিএর অনুমোদন রয়েছেও বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়। সিজিএর সম্মতির মানে সারা বাংলাদেশের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার জন্য নির্দেশনা। আর যদি তাই হয় তা হলে এ টাইমস্কেল সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রের ১০কোটি টাকা যে লোপাট হচ্ছে প্রতি মাসে-বছরে, তা ফেরত নেওয়া হচ্ছে না কেন?

শিক্ষা বিভাগের Cost Centre এর তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষা অফিসারগণ কোন পরিপত্রের প্রেক্ষিতে বিপুল অর্থ উত্তোলন করছেন? সংক্ষুব্ধ ও সচেতন শিক্ষক সমাজ অনিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় টাইমস্কেল সুবিধা নেওয়া এবং পদোন্নতিতে যাওয়ার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়ে প্রতিকারের জন্য আবেদন নিবেদন করায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের অহেতুক অভিযোগ দিয়ে হয়রানি, হুমকি প্রদানের মাধ্যমে নিভৃত করার চেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে। যা নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে পরিপন্থী। এহেন কর্ম অনভিপ্রেত এবং আইনানুগ শাস্তিযেগ্য অপরাধ। হুমকি দাতা ও ইন্ধনদাতাদের হয়রানির বিষয়ে সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর থানায় জিডি করাও হয়েছে ইতিমধ্যেই।

সুবর্ণচর উপজেলার চর জুবিলী অজিফা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক রহিমা খাতুন পূর্বে বিদ্যালয়ের কর্মরত শিক্ষিকা ফারজানা মুকিতকে কৌশলে হটিয়ে নিজে আত্তীকৃত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ রকম দুর্নীতি ও বিধিবহির্ভূত কাজ নোয়াখালীর অন্য উপজেলা ও সারা বাংলাদেশে সংঘঠিত হয়েছে যা সদ্য জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিসহ সনদপত্র যাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে বলে প্রমাণ মিলবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি এক্ষেত্রে।

মো. সিদ্দিকুর রহমান: আহবায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম ও দৈনিক শিক্ষার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053279399871826