‘বিলাসিতার জন্য নয়, পরিবার পরিজন নিয়ে দুবেলা ভাতের জন্য ক্লাস ছেড়ে রাস্তায় এসেছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী যাদের আমরা পড়িয়েছি, তাদের অনেকে বড় বড় চাকুরি করছে বর্তমানে। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোন বেতন পেলাম না।’ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশনে থাকা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার একজন শিক্ষক শনিবার (১৩ই জানুয়ারি) এমনভাবেই তার কষ্টকথা প্রকাশ করেন।
প্রেসক্লাবের সামনে কথা হয় ঠাকুরগাও জেলার রাণীসংকৈল আরাজীচহট বিথি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার পঞ্চাশোর্ধ শিক্ষক মো: আব্দুল আলীর সঙ্গে। দৈনিকশিক্ষাকে তিনি বলেন, হাড় কাপানো কনকনে শীত যেখানে যুবকদের টিকে থাকা কঠিন, বয়সে থাকার কথা সন্তান-নাতিদের সেবায় সে বয়সে এসে রাত কাটাতে হচ্ছে রাস্তায় পাতলা একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে। আব্দুল আলী দৈনিকশিক্ষাকে বলেন, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিক্ষকতা করছেন। র্দীঘদিনের শিক্ষতার জীবনে সরকারের তরফ থেকে কোনও বেতন পাননি। পরিবারে ৬ সন্তান, স্ত্রী, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে। ৫৪ বছর বয়সে এসে শিক্ষক মানুষ এ অবস্থায় না পারছি জমিতে কাজ করতে, না পারছি ভিক্ষা করতে। কথাগুলো বলতে বলতে হাঊমাঊ করে কেঁদে ফেলেন আব্দুল আলী।
তিনি আরও বলেন, তিনবেলা ঠিকমতো খাওয়াতে পারিনা, পড়াশুনার খরচ দিতে পারি না, ভালো পোশাক দিতে পারিনা বলে লজ্জায় ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আজ ১৪দিন থেকে এখানে আছি বাড়িতে মরণাপন্ন বৃদ্ধ মা কেমন আছেন তাও বলতে পারব না।
শুধু আব্দুল আলী নয়, একরম মর্মস্পর্শী কথা শুনিয়েছেন কবির হোসেন, আ: মান্নান, মো: কাদের আলী, মিজানুর রহমানসহ আরও অনেক শিক্ষক।
বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির ব্যানারে গত ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে আসছেন ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। পরে ৯ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করছেন তারা।
কারমাইকেল কলেজ, রংপুর থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভগে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ৬ বছর ধরে মৌজা শৌলমারি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন মো: সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন, “সংসারে মা বাবা, ছোট ৩ ভাই সবার খরচ চালাতে হয় আমাকে কিন্তু কোন বেতন নেই। তিনি আরও বলেন, “গ্রামে প্রাইভেট পড়িয়ে কোনভাবেই সংসার চালাতে পারছিনা, ৩৩ বছর বয়সে এসেও বিয়ে করার সাহস পাচ্ছি না”।
মেদনীসাগর স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার আরবী সাহিত্যের শিক্ষক মো: জামাল উদ্দিন জানালেন তার দু:খের কথা। তিনি বলেন ২৫ বছর শিক্ষকতার জীবনে নিজ হাতে অনেক শিক্ষার্থীকে বৃত্তির টাকা দিলেও নিজে আজ পর্যন্ত বেতন পায়নি। তিনি আরও বলেন, “এরশাদ সরকার, খালেদা সরকার আমাদেরকে বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত বেতন দেয়নি, আমরা আশা করব বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের আশাহত করবেন না তিনি আমাদের দু:খ বুঝতে পারবেন, তিনি আমাদের দাবি মেনে নিবেন।
মো: মহিবুল্লা নামের আরেক মাদ্রাসা শিক্ষক দাবি করেন, “বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ইবতেদায়ি পর্যায় সবচেয়ে অবহেলিত, অন্যান্য সবার মতো পাঠদান করেও আমরা কেন বেতন পাব না সে প্রশ্ন সরকারের কাছে”।
৪৫ বছর বয়সী শিক্ষিকা আসমা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ২০ বছর যাবত চাকুরি করি। কিন্তু বেতন নেই। তাই বাধ্য হয়ে বৃদ্ধা শাশুড়িকে বাসায় রেখে রাস্তায় এসেছি জাতীয়করণের দাবিতে। ৩ বছরের মেয়েটি ফোনে কান্না করে বাসায় ফিরে যেতে বলে। কিন্তু কোন মুখ নিয়ে যাবো বলেন?
এদিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে খোলা আকাশের নিচে কন কনে শীতে ও ক্ষুধায় দেড়শতাধিক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।টানা আট দিন অবস্থান ধর্মঘটের পর গত মঙ্গলবার (৯ই জানুয়ারি) থেকে শুরু হওয়া আমরণ অনশনে শনিবার (১৩ই জানুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৪৫ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অধিকাংশ শিক্ষক অতিরিক্ত ঠান্ডায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন ১৮ জন।
বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মহাসচিব কাজী মোখলেছুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনশনরত অসুস্থ শিক্ষকদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মেডিকেল টিমের আবেদন করা হলেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে কোন জবাব দেয়া হয়নি। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজন গ্রাম্য ডাক্তার আছেন। তারাই প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন।