বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরিই নোট গাইড ও কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পরিকল্পিত ভাবেই শিক্ষক শিক্ষার্থী তথা শিক্ষাব্যবস্থাকে এই ফাঁদে ফেলা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশের দশকের কিছু কিছু স্মৃতি আজ মনের মাঝে উঁকি দেয়। সেই সাথে মনে পড়ে কবিতার সেই চরণগুলো ‘আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা। তোমাদের যুগে তোমরা এখন লেখাপড়া করমেলা’ চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বদরপুর গ্রামের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ের ছোট শিশুটি তখন শিক্ষার সুযোগ পেতে দিশেহারা। কমপক্ষে ১০ মাইল পথ হেঁটে শিক্ষার অন্বেষণে যেতো হাজিগঞ্জ উপজেলার বলাখাল উচ্চ বিদ্যালয়ে। প্রতি বছর জানুয়ারি মাস এলে পুরনো পাঠ্যবই কেনার জন্য আসতো ১৫ মাইল হেঁটে হাজিগঞ্জ বাজারে। এত দূর হেঁটে স্কুলে যেতে কিংবা বই কিনতে যেতে কোন ক্লান্তি ছিল না। বরং আনন্দের তৃপ্তিমাখা অপরিসীমতা ছিল। নতুন বইয়ের গন্ধ জোটেনি পাড়াগাঁয়ের অনেক শিক্ষার্থীর ভাগ্যে। অথচ আজকাল গ্রামে গ্রামে স্কুল। জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ সকল শিশু পায় বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই। যা বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পাকিস্তান শাসনামলে পাড়াগাঁয়ে নোট বইয়ের কোন অস্তিত্ব ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে এসএসসিতে টেস্টপেপার ও পরবর্তীতে মেইড ইজি নামক নোটের পর পর দ্রুত প্রচলন হয় নোট গাইড। বর্তমানে চলছে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত নোট গাইডের রমরমা বাণিজ্য।
নোট, গাইড ও কোচিং ব্যবসার ব্যাপক সফলতার প্রধান কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় অব্যবস্থাপনা। শিশু শিক্ষা চলছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে। বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষকের মর্যাদা, বেতন, শিক্ষক সংকট, শিক্ষকের আন্তরিকতা, অতিরিক্ত সৃজনশীলতার নামে পাঠ্যবইকে অকার্যকর করা, নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রতি পর্যাপ্ত যত্নের অভাব, প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক দ্বারা যত্রতত্র পাঠদান, শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বাজেটে অপরিসীম কৃপণতা ইত্যাদি নানা কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ কাঙ্খিত মেধাবিকাশ ঘটাতে পারছে না।
বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো: স্বাধীনতার দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও আজও খোলা আকাশের নিচে, পরিত্যক্ত ভবনে চলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। যেখানে রয়েছে আসবাবপত্র, সুপেয় পানি, স্যানিটারি ল্যাট্রিন, খেলাধুলা ও বিনোদনের তীব্র সংকট। আজও প্রভাবশালীদের দখলমুক্ত হয়নি কতিপয় বিদ্যালয়। শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণ শিক্ষার অভাবে বিদ্যালয়ের পরিবর্তে নোট, গাইড, গৃহশিক্ষক , কোচিং সেন্টারের আশ্রয় নিচ্ছে।
শিক্ষকের মর্যাদা: গ্রামে, গঞ্জে, শহরে জনগণের কাছে শিক্ষকের সম্মান থাকলেও তা ভুলন্ঠিত হতে চলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। বিগত বছরগুলোতে ছুটির তালিকা প্রণয়নের শিক্ষকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান লাভ করতে পারছেনা। অথচ সংশ্লিষ্টদের অনমনীয় মনোভাব শিক্ষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। যা সরকারের সাথে প্রাথমিক শিক্ষকদের দূরত্ব তৈরি করছে আজও শিক্ষকদের তাদের সামান্য প্রাপ্তির জন্য রাজপথে আর্তনাদ, অনশন, ধর্মঘট করতে হয়। যা সভ্য সমাজ ও দেশে অনভিপ্রেত। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের মত এদেশের শিক্ষকেরা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার মর্যাদা পেয়ে শিক্ষকতা পেশায় আন্তরিকতার সাথে মনোনিবেশ করলে শিক্ষার্থীরা নোট, গাইড ও কোচিং সেন্টারের অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে।
শিক্ষকদের বেতন: ইংরেজ আমলে সমাজের ধনি, শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ শিক্ষকতা পেশায় আসতো। তাদের অর্থের পিছুটান ছিল না। শিক্ষকতাকে সমাজসেবা হিসেবে গণ্য করতো। আজকাল সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেধাবী বা ধনিক শ্রেণির লোকেরা শিক্ষকতা পেশায় আসে না। মানুষের মনে ভাবনা জম্মেছে যার নাই কোন গতি, সেই করে পন্ডিতি। আজও শিক্ষকদের পরিবার পরিজনের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা শিক্ষকতা পেশায় মনোযোগী হতে পারছেন না। কেউ কেউ কোচিং টিউশনি বা খন্ডকালীন অন্য পেশায় নিয়োজিত হন। অথচ এসব কাজকে সংশ্লিষ্টরা অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। শিক্ষকদের অভাবের যন্ত্রণায় রেখে জাতিকে সুশিক্ষিত করার চিন্তা স্বপ্ন ব্যতিরেকে কিছুই নয়। স্বপ্নে বসবাস করে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হচ্ছে নোট, গাইড ও কোচিং সেন্টারের দারস্থ হতে।
শিক্ষকের সংকট: দেশ সংকটের পাহাড় অতিক্রম করে আজ বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে চলেছে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষক সংকট লেগেই আছে। এ যেন জন্ম থেকে পাওয়া, অদৃষ্টের লিখন, এদিকে সদয় দৃষ্টি দেওয়ার কেউ নেই। শিক্ষা মৌলিক চাহিদা। যেখানে শিক্ষক সংকট দূরীকরণের কারণে সংশ্লিষ্টদের শাস্তি পাওয়ার কথা, সেখানে লম্পঝম্প করে নিজেদের দোষ না দেখে বলে, পরীক্ষার ফল খারপ কেন? আরও কত কী। শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণ বাধ্য হয়ে পাসের জন্য নোট, গাইড, গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের সন্ধান করেন।
শিক্ষকদের আন্তরিকতা: প্রাথমিক শিক্ষকরা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও শিক্ষাদান বহির্ভূত কাজের চাপে তারা থাকে জর্জরিত। এসব কাজের চাপে তারা হারিয়ে ফেলে শিশুদের প্রতি আন্তরিকতা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী শিক্ষকেরা সরকারের থার্ড ক্লাস কর্মচারি, তৃণমূল পর্যায়ে এতো থার্ড ক্লাস কর্মচারি আর কোথাও নেই বিধায় শিক্ষকদের ছাড়া সরকারের কাজ করানোর আর কে আছে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার কাজে শিক্ষকদের সারা বছর অফিসমুখী রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের পাঠদানে যতই ক্ষতি হোক না কেন, সমাপনী পরীক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক, অভিভাবক সম্মানিত হন পাসের বা এ+ বাহবা নিয়ে। পাঠে ঘাটতি হলেও পাসে ঘাটতি নেই। কোন কোন শিক্ষক গভর্নমেন্টের লোক বলে শিক্ষাদানে আন্তরিকতা প্রদর্শনের চেয়ে বেশি আন্তরিক থাকেন পাঠদান বহির্ভূত বা ব্যক্তিগত কাজে তাদের প্রতি করজোড়ে অনুরোধ অনেক পেশা বা কাজ আছে সে পেশায় চলে যায়। শিক্ষার্থীদের নোট, গাইড কোচিং সেন্টারমুখী করবেন না।
সৃজনশীলতার নামে বাড়াবাড়ি: ৫ম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় পাঠ্যবই বর্হিভূত প্রশ্ন থাকবে। তাই সংশ্লিষ্টরা ৩য় শ্রেণি থেকে পাঠ্যবই বর্হিভূত প্রশ্নের অবতারণা করে থাকে। শৈশবেই পাঠ্যবই বর্হিভূত প্রশ্নের চর্চা করাতে অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এক বা একাধিক নোট, গাইড বইয়ের আশ্রয় নেয়। বিগত বছরগুলোতে সমাপনী পরীক্ষায় বাংলা রচনা ৪টির মধ্যে কমপক্ষে ৩টি পাঠ্যবই কেন্দ্রিক দেয়া হয়ে থাকে। অথচ ২০১৫-২০১৭ সালে সব কয়টি রচনা পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে এসেছে। এক্ষেত্রে নোটগাইড ছাড়া অধিকতর সহযোগিতার জন্য শিক্ষার্থীদের আর কোন উপায় নেই। বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান ও ধর্ম শিক্ষা বিষয়ে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন আসে ৫০টি। পরীক্ষা বা ক্লাস টেস্টেও সময় শিক্ষকরা ৩টি বিচলক যা ভুল উত্তর তা সংগ্রহে নোট, গাইডের সাহায্য নেন। এক্ষেত্রে নোট গাইড শিক্ষকদের সময় বাচাঁয় ও চিন্তাভাবনা মুক্ত রাখে। পাঠ্যপুস্তকের অনুশীলনীর প্রশ্ন পত্রের ধরণের সাথে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই শিক্ষার্থী অভিভাবক এমনকি শিক্ষকেরা স্বত:ফুর্তভাবে নোট গাইডের দ্বারস্থ হয়। বছর বছর পরীক্ষার বিশেষ করে সমাপনী পরীক্ষার মানবন্টন পরিবর্তন করায় নোট-গাইডের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
নিচের ক্লাসে পর্যাপ্ত যত্নের অভাব: শিক্ষক, অভিভাবক, কর্মকর্তা, মন্ত্রী সকলে বাহবা বা তৃপ্তি অর্জন করে সমাপনী পরীক্ষার ফল নিয়ে। ৫ম শ্রেণির ক্লাস নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করতে দেখেছি। নিচের ক্লাসে যেনতেনভাবে পড়ানো নিয়ে শিক্ষকদের অনেকের মাঝে কোন ভাবনা থাকে না। এছাড়া সমাপনীর বিরাট কর্মযজ্ঞ পালনে অনেক শিক্ষককে স্কুলের পরিবর্তে সারাবছর অফিসে কাজ করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন ট্রেনিং-এর ব্যাপকতা ও সরকারি দপ্তরের হুকুম তামিল ও তথ্য দাখিলের কারণে শিক্ষকদের নিচের ক্লাসের শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্ন নেওয়া সম্ভব হয় না। অনেকটা গোড়ায় পানি না দিয়ে আগায় পানি দেওয়ার মত। ফলে অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে কোচিং সেন্টারমুখী হয়। যাদের ভালো ফলাফলের পিছু সবাই ছুটছে তারা কতটা শিখছে তাই আজ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশিক্ষণবিহীন পাঠদান: দেশে যত্রতত্র গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন বা উচ্চ বিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদের বর্তমান যোগ্যতাভিত্তিক পাঠদানের কোন প্রশিক্ষণ নেই। শিশুশিক্ষার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ নেই। অনুরূপভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসকল স্কুলকে ৮ম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে, সেসব স্কুলের শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন পাঠদান বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নাই। তারা বাধ্য হয়ে নিজের জানার জন্য নোট গাইড অনুসন্ধান করে এবং শিক্ষার্থীদের নোট, গাইড কিনতে বাধ্য করে। এগুলোর পূর্বে অল্পবিস্তর ব্যবহার থাকলে বর্তমানে সৃজনশীলতার নামে প্রকাশ্যে নির্দ্বিধায় ব্যবহার বাড়ছে। সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখা গেছে মতিঝিল থানায় আইডিয়েল মুসলিম সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহামিদা সুলতানাসহ খুব কম নগণ্য সংখ্যক শিক্ষক নোট গাইডের বেড়াজাল থেকে মুক্ত।
শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেটের কৃপণতা: আমরা অনেকে সার্বিক দিক বিবেচনা না করে নিজেদের মতো করে ভাবনা সকলের ওপর চাপিয়ে দেই। আমাদের প্রাজ্ঞ অর্থমন্ত্রী পরিবারে সচ্ছলতার কারণে দেশ বিদেশে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট কৃপণতা দেখে মনে হয় এদেশের মানুষের শিক্ষার সুযোগ তাঁর মতো। দেশের শিক্ষাবিদ এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তাঁর ভাবনাকে টলাতে পারিনি। যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীর কাঙ্খিত চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। তাই অভিভাবক শিক্ষার্থী সমবেতভাবে ছুটছে নোট, গাইড ও কোচিং সেন্টারের দিকে। এ ছুটা যেন বিদ্যালয় ভর্তির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
শিক্ষার প্রসারে বাস্তবমুখী গবেষণা: স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পর তৃণমূলের মানুষের সন্তানদের নিয়ে তেমন কোন ইতিবাচক ভাবনা দেখা যায়নি। তাদের কাছে শিক্ষার গবেষণার মাপকাঠি হচ্ছে কর্তাব্যক্তিদের সন্তানদের মেধা, জ্ঞান সাধারণ মানুষের সন্তানদের জ্ঞান। সমস্যাকেন্দ্রিক গবেষণা দৃশ্যমান নয়। যার ফলে সাধারণ মানুষের সন্তানদের মেধাবিকাশ জ্ঞানঅর্জন অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে। নোট, গাইড ও কোচিং সেন্টারের সমাদৃত হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আগামী প্রজম্ম বেড়ে উঠুক জ্ঞান অর্জন ও মেধাবিকাশের মাধ্যমে। এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।