পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও শিক্ষার বাণিজ্য

শেখ রাশেদুজ্জামান রাকিব |

পরিচিত এক ছোট ভাই সকালে ফোন দিয়ে অত্যন্ত প্রফুলভাবে সঙ্গে জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অনেক ভালো দিয়েছে। ওর আনন্দটা আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন দেহে নিমিষেই চঞ্চল আবহের সূত্রপাত করে। কেননা, এতদিন ওর মুখে হাসির ঝিলিক লাগেনি। অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে উচ্চ বিদ্যাপীঠে ঠাঁই করে নেবার জন্য নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পিছুটান ছিল অনেক- যেমন আর্থিক দীনতার জন্য অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোচিং করতে পারেনি, ফরম ওঠানোরর টাকাটাও অন্যের কাছ থেকে ধার করা।

যদি ও কোচিং করাটা আবশ্যক না তবুও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে টিকতে এটা গতানুগতিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। ওর আর্থিক অনটন, না খেয়ে থাকা দিনগুলো, ফরমের টাকার জন্য মানুষের দুয়ারে হাত পাতার দৃশ্য আর উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে করতে আবার ফোন পাই ওর কাছ থেকে। এবার মলিন কণ্ঠ, অনেকটা কান্নাবিজড়িত আর নেতিয়ে পড়া অসহায় মানুষের অরন্যে রোদনের মতো, ভাইয়া, সবাই বলছে প্রশ্ন নাকি ফাঁস হইছে, আবার নাকি পরীক্ষা হবে? এরপর যদি আমার পরীক্ষা ভালো না হয়? আমি যে মায়েরে ফোন দিয়ে কইছি আমি এখানে চান্স পাবো, অনেক ভালো পরীক্ষা হইছে আমার। আমার গ্রাম্য ভাইটির কথাগুলো আমি শুধু বোবার মতো শুনে গেলাম। বুঝলাম ওর চিন্তিত হবার সুদীর্ঘ আরো অনেক কারণ আছে। আবার পরিবহনের ভাড়াটার জন্য ও কার কাছে হাত পাতবে? কিন্তু ওর অভিযোগগুলো সমাধানের প্রচেষ্টা কার আছে? না রাষ্ট্র, প্রশাসন,বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করা মানুষ, মুক্ত বুদ্ধিজীবী বা বরেণ্য রাজনীতিবিদ।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে না দেখে শুধু বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ জন্যই দেখা যায় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য উপচে পড়া ভিড়। এখানে বলা আবশ্যক যে,
এসব ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ইচ্ছা জ্ঞান অর্জনের নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে পিতা-মাতার অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা প্রদর্শন, বিকৃত রাজনৈতিক চর্চার বাসনা বা লোভনীয় চাকরির নিশ্চয়তা লাভ।

সত্যিই দিন দিন অসহায় হয়ে যাচ্ছি আমরা। ফেসবুকে অসংখ্য অভিযোগ, ধূর্ততা না শেখা কিশোরী বা গ্রাম্য ভাইটির অভিমানে লেখাÑ ধিক্কার জানাই এই শিক্ষা ব্যবস্থার, এই ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা আর চাই না। আচ্ছা সত্যিই কি আমাদের রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে ইতিবাচক সব ধরনের চিন্তা-চেতনা, প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনার পথ পরিহার করছে? প্রায় পাঁচ দশক স্বাধীনতার পথ অতিক্রম করে আসা এ দেশটি শিক্ষা-দীক্ষায় অনেকটা ত্বরিত গতিতে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবে এগিয়ে চললেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা আমাদের ইতিবাচক পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। দেশে শিক্ষার সর্বনিম্ন স্তর থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের ফাঁসের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে ডিজিটাল জালিয়াতি ও অসাদুপায় অবলম্বনের ঘটনা।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটা গুজব সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে মিডিয়াপাড়া পর্যন্ত গড়িয়েছে। যেহেতু ইস্যুটা মিডিয়ার পর্যন্ত গিয়েছে সুতরাং সেটাকে আর শুধু গুজবের পর্যায়ে রেখে অপরিপক্বতার পরিচয় দেয়া অনর্থক হবে। এ ঘটনা এর আগেও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় হতে দেখা গিয়েছে। ২০১৫ সালে মেডিকেল এর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-ছাত্রীদের অনশন করতে দেখা গিয়েছে। পরিনামে প্রশাসনের সঙ্গে বৈরিতার উদ্ভব ঘটে হেনস্থার স্বীকার ও শারীরিক লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হয়েছে। যে তরুণ লাইব্রেরীতে বসে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব বা রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের রস আবাদন করবে তাদের কেন রাস্তায় রৌদ্রে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে অনশন করতে হবে? এ অনশন তো বায়ান্নর ভাষা বাঁচানোর বা আটাশির স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন না।

পাবলিক পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়ের পর অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এটা আমাদের দেশে শিক্ষা মানুষের অন্তরাত্মার কলুষতা দূর করে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সুনাগরিক গড়ে উঠতে সহায়তা করে। শিক্ষার ছোঁয়ায় সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষণ ঘটে সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে অর্থনীতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তির চলার পথ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা পুস্তকে শিক্ষার ব্যাখ্যা এরিস্টটলের শিক্ষানীতির আলোকে দিলেও বাস্তবে নিজ সন্তান বা ছাত্রকে ক্ষমতা ও অর্থ কেন্দ্রভূত করার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা দিয়ে থাকি। সমাজে গণতন্ত্রের ব্যাঘাত ঘটে এমন এক রুগ্ন দশায় পরিনত হয়েছে যে, আমরা অর্পিত বা বৈধ ক্ষমতা ও স্বেচ্ছায় কর্তৃত্ব খাটানোর মধ্যে ব্যবধান করতে অক্ষম। এ জন্য কোনো গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বেব নিজেদের অন্তর্ভুক্তি করার পর উপলব্ধি করি সন্তানকে প্রশাসনিক বড় অফিসার বানাবো ক্ষমতা অর্জনের জন্য।

অথচ আমরা এ সময় ভাবিনা যে, এ অফিসারের আইনানুগ ক্ষমতা থাকবে দেশের স্বার্থ অর্জনের জন্য, নিজেদের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব খাটানোর জন্য নয়। আমরা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অতিমাত্রায় ক্ষমতার প্রভাব অনুভব করি। আর এ ক্ষমতা অর্জনের জন্য নামমাত্র শিক্ষাকেই অন্যতম পন্থা হিসেবে বিবেচনা করি। এ জন্যই শিক্ষার বাণিজ্যিক পথ এতটা উন্মুক্ত। কেননা আমরা অনুভব করি ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে বা অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব আরোপের জন্য শিক্ষানামক এ পণ্য সবার জন্য আবশ্যক। সুতরাং এ পণ্য বিক্রয়ের জন্য ব্যক্তিগত অনেক মানুষ বা কোম্পানির যথা- তথা দোকান স্থাপনের দৃষ্টান্ত আমাদের চোখে পড়ে। আমাদের কোচিং বাণিজ্য রমরমা চলে। তবে শুনতে তিক্ত লাগলে এ কথা মানতে হবে যে, শ্রেণীকক্ষে যে তাত্ত্বিক পাঠ প্রদান করেন শিক্ষকরা, কোচিংয়ে তার

চেয়ে একটু হলেও বেশি যতœশীল তারা পাঠদানের ব্যাপারে। সুতরাং আমাদের খাতগুলো নিরুপণ করে তদুপরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু কোচিং বন্ধে ভুরি ভুরি আইন করলেই সব সমস্যার মূলোচ্ছেদ হবে না। আমাদের সার্বিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য আইনের অভাব নেই; আছে শুধু প্রকৃত শিক্ষাপ্রাপ্ত

সুনাগরিকের অভাব। এজন্যই হাজারো আইন থাকলে আইনের শাসন নেই দেশে। আমাদের সঠিক শিক্ষাপ্রাপ্ত সুনাগরিকের অভাব আছে বলেই আইন ব্যাখ্যায় দলীয় স্বার্থ দেখা যায়, ভুল তথ্য-উপাত্ত দ্বারা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়, অসহিষ্ণু রাজনৈতিক চর্চা হয়, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে রমরমা দুর্নীতির চর্চা হয়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে না দেখে শুধু বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ জন্যই দেখা যায় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য উপচে পড়া ভিড়। এখানে বলা আবশ্যক যে, এসব ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ইচ্ছা জ্ঞান অর্জনের নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে পিতা-মাতার অযৌক্তিক প্রতিযোগিতা প্রদর্শন, বিকৃত রাজনৈতিক চর্চার বাসনা বা লোভনীয় চাকরির নিশ্চয়তা লাভ। এসব কথা বলার মধ্যে অতি বাস্তব সত্যের উদ্ভব ঘটলেও শিক্ষার নীতিনির্ধারকগণ এ নিয়ে উৎকণ্ঠিত নন। আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলে এ নিরেট সত্য উঠে আসবে যে, প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মূল্যবোধ বা প্রতিবাদী চেতনাসম্পন্ন মানুষের জাগরণ ঘটলে বিকৃতভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা বা একচ্ছত্রভাবে পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলাদের উচ্ছেদ ঘটবে এ আশঙ্কায় শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বা সঠিক পন্থায় পরিচালনা করতে এসব গোষ্ঠীর এত অনীহা। মূলত এরা কৌশলে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার ধূর্ত পন্থা অবলম্বন করছে।

যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অথবা ফাঁস হয় বা জাতিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির এ বিকৃত প্রতিযোগিতা সেখানেও তো সঠিক শিক্ষা বা ইতিহাস চর্চা হয় না। এখন শিক্ষকরা ছাত্রদের সৃজনশক্তিকে আবিষ্কারের চেয়ে তাদের পেশি বা অর্থশক্তিকে উপলব্ধি করার প্রচেষ্টা চালান যাতে তাকে নিজ দলে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সব কিছুতেই দলীয়করণের প্রভাব এতটা বেশি হয়ে গেছে যে, আদালতপাড়া, মিডিয়াপাড়া বা স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়পাড়া সব জায়গাতেই দুই ধরনের দলীয় ইতিহাসের চর্চা হয়। তাদের এ দলবাজির দ্বারা দলীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আইন, ক্ষমতা সবকিছুই নিজেদের অনুকূলে নিয়ে নেয়।

যার ফলেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোতে পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। শিক্ষার এ রুগ্ন দশা দেখে বারবার নেপোলিয়ানের সেই উক্তি অনুকরণ করে বলতে হয়- ‘আমাকে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন দাও, আমি তোমাদের একটা মেরুদন্ডহীন জাতি উপহার দেব’। যে দরিদ্র বা কোমল শিক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ ঘটনা দেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে গালি দেয় তাদের কেমনে বোঝাই যে এর রীতি প্রণয়ন ও পরিচালনা করে রক্তে মাংসে গড়া কিছু মূর্ত মানুষ। এ মানুষগুলো আবার সমাজের উচ্চস্তরে থাকা কিছু ক্ষমতাবান বা পুঁজিপতিদের চাকর। আর সেই ক্ষমতাবানদের ছত্রচ্ছায়ায় প্রশ্নপত্র জালিয়াতির ঘটনা ঘটায় কিছু মানুষ যাদের কাছে আইন প্রয়োগকারীরাও অসহায়। এই যে গোটা ব্যবস্থায় এই গলদ। এই গলদ একমাত্র প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা বা পরিবর্তন করা সম্ভব। কিন্তু সেই প্রকৃত শিক্ষার স্বাদ এই পুঁজিপতি বা শাসকগোষ্ঠী কোন দিনই যে, আমাদের দিবে না।

[লেখক : কলামিস্ট]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006080150604248