পাঠ্যপুস্তকে বাদ যাওয়া লেখা পড়বে শিশুরা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বছরের প্রথম দিনেই রাশি রাশি হাসিমুখ। হাতে নতুন বই নিয়ে শিশুদের উচ্ছ্ব্বাস মন ভালো করে দেয়। কিন্তু এবার বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইগুলো খুলে দেখা যায়, বইগুলো থেকে বাদ পড়েছে পুরনো ২২টি কবিতা এবং গল্প-প্রবন্ধ। এসব গল্প-কবিতা ও প্রবন্ধ বাদ পড়েছে হেফাজতে ইসলামের সুপারিশে। হেফাজতের দাবি অনুযায়ী, ‘নাস্তিক’ লেখকদের ‘হিন্দুয়ানি’ লেখাগুলো পাঠ্যপুস্তক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে_ এটা এতদিনে সবার জানা হয়ে গেছে। এতে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঠিক সে সময় মার্চে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ যাওয়া লেখাগুলো নিয়ে সংকলন বের করেন সমুদ্র সৈকত; যার নাম তিনি দেন ‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’। ব্যক্তি উদ্যোগে

এ সংকলনটি খুব বেশি ছড়িয়ে যেতে পারেনি। সে জন্যই তার থেকে অনুপ্রাণিত দেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গত এপ্রিল মাসে প্রকাশ করে নতুন আরেকটি সংকলন ‘পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণ :বাদ দেয়া হয়েছে যেসব লেখা’। হেফাজতের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ যাওয়া লেখাগুলো নিয়ে প্রকাশিত এ সংকলন ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে বিতরণ শুরু করেছে উদীচী।

উদীচীর সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম জানান, মাত্র ১০ টাকা শুভেচ্ছা মূল্যে এ সংকলনটি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, যাতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বুঝতে পারেন, কোন লেখাগুলো পড়তে দেওয়া হয়নি। বাদ দেওয়া লেখাগুলোতে যে ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার মতো কিছু নেই, বরং এ লেখাগুলো শিশুদের মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, তা জানানোর জন্যই এ উদ্যোগ। তিনি জানান, উদীচীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরাও। তাই তারা আশা করছেন, এ উদ্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার আগামী পাঠ্যক্রমের পাঠ্যপুস্তকে লেখাগুলো আবার সংযুক্ত করবে।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ২০১৬ সালের ৮ এপ্রিল একটি যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ১২টি কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধকে বাদ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। সেগুলো হলো_ হুমায়ুন আজাদের কবিতা ‘বই’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সত্যেন সেনের ছোটগল্প ‘লাল গরুটা’, এস ওয়াজেদ আলীর ভ্রমণ কাহিনী ‘রাঁচি ভ্রমণ’, শরৎচন্দ্র চট্টোপ্যাধায়ের ‘লালু’, ‘রামায়ণ’ সংক্ষিপ্ত রূপ, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কবিতা ‘আমার সন্তান’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী ‘পালামৌ’, লালন শাহের গান ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘সাঁকোটা দুলছে’, জ্ঞানদাসের কবিতা ‘সুখের লাগিয়া’। বিবৃতিতে হেফাজত নেতারা সে সময় দাবি করেছিলেন_ ‘এসব পাঠ করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু ইমানহারা হয়েই গড়ে উঠবে না, বরং ইসলামবিদ্বেষী, নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে।’

বছরের শুরুতে দেখা গেল, হেফাজতের চাওয়ার চেয়ে বেশি লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় গত মার্চে প্রথম বাদ পড়া লেখাগুলো নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী সমুদ্র সৈকত ‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তিনি সেই বইয়ের দুই হাজার কপি বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করেন। ‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ সংকলনে ১১টি কবিতা ও পাঁচটি গল্প স্থান পায়। কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে হুমায়ুন আজাদের ‘বই’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সানাউল হকের ‘সভা’, জসীম উদ্্দীনের ‘দেশ’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, বাউল লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘খতিয়ান’। গল্পগুলোর মধ্যে ছিল সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’, এস ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’, রণেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ ভ্রমণ কাহিনী’। এ বইটির প্রচ্ছদ করেন রাজীব দত্ত।

‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ সংকলন বিষয়ে সমুদ্র সৈকত বলেন, ‘এ লেখাগুলো শিশুদের বিনামূল্যেই পড়ার কথা ছিল। সে জন্য আমি বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। বেশ কয়েকজন প্রকাশক চাওয়ার পরও আমি সে জন্য তাদেরকে দিইনি সংকলনটি। সম্পূর্ণ ব্যক্তি-উদ্যোগে আমি এ কাজটি করেছিলাম। সাধারণ মানুষ যাতে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন, সে জন্য উদীচীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও বইটি দিয়েছিলাম। পরে এর সঙ্গে আরও কিছু লেখা যোগ করে উদীচী নতুন করে বইটি প্রকাশ করেছে। এটি আসলে সাধুবাদ জানানোর মতো কাজ। কেননা, বিশাল এ সংগঠনটির মাধ্যমে এ লেখাগুলো আরও ছড়িয়ে পড়বে।’

এর পর এপ্রিল মাসে উদীচীর সহ-সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে সম্পাদিত ‘পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণ :বাদ দেয়া হয়েছে যেসব লেখা’ বইটি প্রকাশ করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। এর প্রচ্ছদ করেন রহমান মুফিজ। এ বইটিতে সমুদ্র সৈকতের ‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ সংকলনের লেখাগুলো ছাড়াও যুক্ত করা হয় সুকুমার রায়ের ‘আনন্দ’, কালিদাস রায়ের ‘অপূর্ব প্রতিশোধ’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে দিনের কবিতা’, স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘উপদেশ’, ফয়েজ আহ্মদের ‘স্মৃতিসৌধ’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাই’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লাল ঘোড়া’, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘লাইব্রেরি’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’। এর মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে দিনের কবিতা’ সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম-দশম শ্রেণিতে এবং গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’ কবিতা পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করা হয়েছে।

উদীচীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন বলেন, ‘এ বইটি একটি আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা চাই, এ বই পড়ে মানুষ জানুক_ যে লেখাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে ক্ষতিকারক কিছু নেই। বরং এ লেখাগুলো একটি প্রজন্মকে মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও সহনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। সে সঙ্গে এ বইয়ের মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে দাবি রাখতে চাই_ যেন তারা বাদ দেওয়া লেখাগুলো পুনরায় পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করে।’ বইটি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বই ছাপাতে পেরেছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে এ বইটি বিতরণের জন্য আমাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে। আমরা দ্রুত আরও কিছু বই প্রকাশ করার উদ্যোগ নিচ্ছি।’

বইটির সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘হেফাজতের দাবির মুখে যেসব লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আসলে শিশুদের মন ও মনন তৈরি, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখত। কিন্তু সেগুলোকে বাতিল করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংকলনের প্রসঙ্গকথায় আমরা বলেছি, এর আগে পাকিস্তান শাসনামলে ময়মনসিংহকে মোমেনশাহী, সিলেটকে জালালাবাদ, বিজয়নগরকে ফতেহনগর, কৃষ্ণচূড়া ফুলকে ফাতেমাচূড়া_ নামকরণে এমনই সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছিল ব্যুরো অব ন্যাশনাল রি-কনস্ট্রাকশন (বিএনআর) নামে একটি সংস্থা, যা তৈরি হয়েছিল দেশের সংস্কৃতি থেকে ‘হিন্দুয়ানি’ বিষয়াদি বাদ দেওয়ার জন্য। অন্ধকার যাত্রার পথে আলোর সন্ধান দিয়েছিল যাদের রচনা, সেসব আলোকিত লেখকের লেখাগুলো বাদ দিয়ে চলতি বছরের পাঠ্যবই প্রকাশ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), যা পাকিস্তান আমলের পুনরাবৃত্তি।

উদীচীর এ বই সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে নতি স্বীকার করে পাঠ্যপুস্তকে এ পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। উদীচীর এ উদ্যোগকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এর ফলে মানুষ বিচার করতে পারবে_ লেখাগুলোকে অন্যায়ভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।’ জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। এর ফলে সাধারণ মানুষ জানতে পারবে, যেসব লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ লেখাগুলো কোনোভাবেই বাদ যেতে পারে না। কারণ, এখানকার কোনো লাইন ও কথা ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানার মতো নয়।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত - dainik shiksha ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল - dainik shiksha শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল - dainik shiksha ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027709007263184