পাঠ্যবই মুদ্রণে ৪২৭ কোটি টাকার অনিয়ম

রাকিব উদ্দিন |

পাঠ্যবই মুদ্রণ, কাগজ ও কালি ক্রয় এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ে ৪২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। বিগত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে এই দুর্নীতি হয়ে আসলেও বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে আসছে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের নানা অনিয়ম নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই আর্থিক অনিয়মের তথ্য প্রকাশ পায়। এখন নড়েচড়ে বসেছে এনসিটিবি ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘অডিট আপত্তি হয়েই থাকে। এগুলো আবার তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নিষ্পত্তিও হয়।’

৪২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার এত বড় আর্থিক অনিয়ম কীভাবে হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের কোন তথ্য আমার কাছে নেই। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বলতে হবে।’ তবে এনসিটিবির যে প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, সেটিতে অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা, বাজেট ও অডিট অফিসার এবং প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ সালে ১৪টি অডিট আপত্তিতে বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় তিন কোটি ১৪ লাখ ১৮ হাজার ৯০৬ টাকার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর আগে ২০১৩-১৪ সালে ২০টি অডিট আপত্তিতে ৭৩ কোটি ১৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৪৯ টাকার অনিয়মের প্রমাণ এবং ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে ১৭টি অডিট আপত্তিতে আট কোটি ৮০ লাখ ৫২ হাজার ৪৭৪ টাকার অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এছাড়া ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সালে ৮৫টি অডিট আপত্তিতে মোট ৩৪২ কোটি ৪২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬২ টাকার অনিয়ম হয়েছিল বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০১৫-১৬ সালের অডিট প্রতিবেদন এখনও প্রস্তুত করা হয়নি, বর্তমানে এটির কাজ চলছে।

৪২৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার অডিট আপত্তির কারণ জানতে চাইলে এনসিটিবির প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। অনেক সময় কেনাকাটার কাগজ, ভাউচার স্লিপ ইত্যাদির প্রমাণ পাওয়া যায় না। এগুলোই অডিটে উঠে এসেছে।’ এগুলো অনিয়ম, দুর্নীতি কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমি বলতে পারব না। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।’

৪২৭ কোটি টাকার অডিট আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির বাজেট ও অডিট অফিসার আবদুল হামিদ  বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ের অডিট আপত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে এটি হয়েছে। এক-দুই বছরে এটি হয়নি। এখানে ১৯৭২-৭৩ সালের অডিট আপত্তির তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে (যদিও প্রতিবেদনে ১৯৭২-৭৩ সালের কোন তথ্য নেই)। এই অডিট আপত্তি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সভা হতে পারে।’ তবে কী কী কারণে এই অডিট আপত্তি হয়েছে, জানতে চাইলে আবদুল হামিদ বলেন, ‘এটা আমার মনে নেই। কাগজপত্র না দেখে বিস্তারিত বলা যাবে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঠ্যবই মুদ্রণে অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয়ে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ‘টিআইবি’র প্রতিবেদন প্রকাশের পর এনসিটিবির অডিট আপত্তি ও নিষ্পত্তির তথ্য চাওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে এনসিটিবির ব্যাখ্যা ও কইফিয়ত চাইতে শীঘ্রই মন্ত্রণালয়ে একটি সভা আহ্বান করা হচ্ছে। এর আলোকেই অডিট আপত্তির ওই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছে দুই মন্ত্রণালয়ের পাঠ্যপুস্তক (শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা) মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা এনসিটিবি।

গত ১৩ নভেম্বর ‘টিআইবি’ প্রকাশিত ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড : পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশনা ব্যবস্থায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এনসিটিবির পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন ও পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনা ও সরবরাহের সর্বমোট ২০টি ধাপের মধ্যে ১৬টি ধাপে সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। আইনবহির্ভূত সম্মানী প্রাপ্তিসহ নানা অনিয়মের কারণে এনসিটিবিতে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

বিভিন্ন নিয়মিত কাজে এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানী নেন উল্লেখ করে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, এ খাতে ২০১৭ সালে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা ও ২০১৬ সালে ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে। সর্বশেষ মহাহিসাব নিরীক্ষকের (সিএজি) নিরীক্ষায় এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করা হলেও তা নিষ্পত্তি হয়নি।
টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, ১৯৭৩ সালের মুদ্রণ আইন অনুযায়ী যারা কাজ পাবেন তাদেরই তা করার কথা। কিন্তু বেশিরভাগই মুদ্রণ, বাঁধাই, ও লেমিনেশনের ক্ষেত্রে সাব-কন্ট্রাক্টে দিয়ে থাকে। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বিএসটিআই সনদবিহীন মিলগুলোর কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে কাগজও কিনে থাকে। একাধিক কাগজ মিল মানসম্মত কাগজ সরবরাহ করতে না পারার অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হলেও পরবর্তী বছরে তাদের কাছ থেকে কাগজ কেনা হয়। পর্যাপ্ত কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতার ঘাটতি, সময়মতো কাগজ সরবরাহ করতে না পারা, চুক্তিবদ্ধ মাপ অনুযায়ী কাগজ সবররাহ না করলেও তাদের কাগজে বই ছাপা হচ্ছে। এনসিটিবির কর্মকর্তাদের একাংশের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

জানা গেছে, এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের প্রেষণে এখানে পদায়ন করা হয়। তারা একই কাজ করলেও নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি বছরে ছয়টি বোনাস পান। এরপরও আবার বিভিন্ন কাজে সম্মানি গ্রহণ করে থাকেন। এছাড়া পাঠ্যবই মুদ্রণের প্রতিষ্ঠান থেকে নানা রকম সুবিধাও নেন কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ কারণে সংস্থাটি লোভনীয় পদে পরিণত হয়েছে।

 

সৌজন্যে: সংবাদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026760101318359