পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে ত্রিমুখী সংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সংস্থাটিতে দক্ষ লোকের অভাব, বিশ্বব্যাংকের ছাড়পত্র প্রদানে বিলম্ব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) সঙ্গে সমন্বয়হীনতার কারণেই ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। অন্যান্য বছরের এই সময়ে (আগস্ট) মাধ্যমিক স্তরের প্রায় অর্ধেক বই মুদ্রণ হলেও এবার এখন পর্যন্ত ছাপার চূড়ান্ত কার্যাদেশই পায়নি মুদ্রণ শিল্প মালিকরা।
এদিকে মাধ্যমিক স্তরের ১২টি বইয়ের কন্টেন্ট (পান্ডুলিপি) পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের কারণে এসব বই ছাপার কাজও পিছিয়ে যাচ্ছে। পান্ডুলিপি চূড়ান্ত না করেই এসব বই মুদ্রণের দরপত্র আহ্বান করেছে এনসিটিবি।
এছাড়া মাধ্যমিক স্তরের (৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী) বই মুদ্রণের জন্য এখন পর্যন্ত ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনই পায়নি বলেও এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে এ কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে বলে বই মুদ্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এসব কারণে ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রায় ৩৫ কোটি ১৪ লাখ কপি পাঠ্যবই মুদ্রণ কার্যক্রম শঙ্কায় পড়েছে। এ অবস্থায় বই মুদ্রণ কার্যক্রমে বিলম্বের জন্য এনসিটিবিকে দায়ী করে সংস্থার চেয়ারম্যানকে আলাদা চিঠি দিয়েছেন ছাপাখানা মালিকদের সংগঠন মুদ্রণ শিল্প সমিতি ও প্রকাশকরা।
পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ কার্যক্রমে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে গত ৩১ জুলাই মতিঝিলে এনসিটিবি কার্যালয় পরিদর্শনে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বইর মুদ্রণের খোঁজখবর নেন। এ সময় এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মন্ত্রীকে জানান, আগামী ১ জানুয়ারির মধ্যে সারাদেশে বই বিতরণে কোন জটিলতার আশঙ্কা নেই। কিন্তু তিনটি ছাপাখানার মালিক জানান, এবার বই ছাপার কার্যক্রমে চরম বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে।
সব স্তরেই জটিলতা
এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, দাখিল, ভোকেশনাল স্তরের জন্য ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪১৫টি বই ছাপা হচ্ছে। প্রতিটি স্তরের বই আলাদা দরপত্রের মাধ্যমে ছাপানোর কার্যাদেশ দেয়া হয়। এবার প্রত্যেক স্তুরের বই মুদ্রণ নিয়েই আলাদা আলাদা জটিলতা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, এবার প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের মোট দশ কোটি ৩৫ লাখ ২৮ হাজার বই ছাপা হচ্ছে ৯৮টি লটের মাধ্যমে। এর মধ্যে ৯৬টি লটের বই ছাপতে ছাড়পত্র দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুটি লটের কাজে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ না দেয়ায় ছাড়পত্র দিচ্ছে না বিশ্বব্যাংক। আবার ৯৬টি লটের ছাড়পত্র পাওয়ার পরও কাজ শুরু করতে পারছেন না মুদ্রাকররা। তারা এজন্য এনসিটিবি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার গাফিলতিকে দায়ী করছেন। আর এনসিটিবি বলছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) এক শ্রেণীর কর্মকর্তার কারণে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ প্রদানে বিলম্ব হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার মান নিয়ন্ত্রণ বা যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শন এজেন্ট নিয়োগ দেয়ার দায়িত্ব ডিপিই’র। পরিদর্শন এজেন্টের ছাড়পত্র ছাড়া ঠিকাদারদের বই মুদ্রণের চূড়ান্ত কার্যাদেশ দিতে পারে না এনসিটিবি। এজন্য সংস্থাটি পরিদর্শন এজেন্ট নিয়োগের জন্য বারবার অনুরোধ করে আসছে ডিপিই’কে। কিন্তু ডিপিই’র এক শ্রেণীর কর্মকর্তা এজেন্ট নিয়োগে গা-ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে। এজন্য মুদ্রাকররা বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারছেন না।
একাধিক লটের কাজ পাওয়া একজন প্রকাশক বলেন, ‘আমাকে এক মাস দেরিতে কাজের আনুষ্ঠানিক ছাড়পত্র (এনওসি) দেয়া হয়েছে। অথচ কাগজ পরিদর্শন করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের দরপত্রই (টেন্ডার) দিতে পারছে না সরকার। এর দায়ভার আমরা নেব না। এই স্তরের বই ছাপিয়ে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে দেরি হলে তার দায়ভার এনসিটিবি ও ডিপিই’কে নিতে হবে। কারণ আমাদের ছাপাখানা অলস পড়ে রয়েছে, শ্রমিকরা বেকার সময় পার করছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘প্রাথমিক স্তরের বই ছাপার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিদর্শন টিম নিয়োগ দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। এজন্য আমরা বারবার তাগাদা দিয়ে আসছি। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত নিয়োগ না দেয়ায় ঠিকাদাররা বই ছাপার কাজ শুরু করতে পারছেন না প্রিন্টার্সরা (মুদ্রাকর)। এর দায় ডিপিইকে নিতে হবে।’ এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শ্রেণীর পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার বইয়ের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে না পারায় টেন্ডার আহ্বান করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এনসিটিবি’র একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অন্যান্য বছর জুনেই মাধ্যমিকের বই ছাপা শুরু হয়। এবার এখন পর্যন্ত ওই প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি এনসিটিবি। গত বছর প্রাথমিকের কার্যাদেশ দেয়ার সময় মাধ্যমিকের ৬০ ভাগ বই ছাপার কাজ শেষ হয়।
এছাড়াও অক্টোবরে আবার নোট গাইড বই ছাপানো কাজ শুরু করবে পুস্তক প্রকাশকরা। এ সময় এ জড়িত কাজের লোক, কাগজ, আর্ট পেপারের মতো কাগজের চাহিদা বেড়ে যায়।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণীর প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার বিনামূল্যের বই ছাপা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব বই ছাপার জন্য এনসিটিবিকে নির্দেশনা দেয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্তু তা পায়নি সংস্থাটি।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদ্রী এ পাঁচটি সম্প্রদায়ের শিশুর মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য বই দেয়া হয়। এসব বই সংশ্লিষ্ট ভাষার বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পান্ডুলপি তৈরি করা হয়।
জানা গেছে, এবার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের শিশুদের বই মুদ্রণ নিয়েও জটিলতা হচ্ছে। কারণ এই সম্প্রদায়ের মধ্যে দুটি গ্রুপ রয়েছে, যাদের একটি গ্রুপ চাচ্ছে- রোমান হরফে ও আরেক গ্রুপ চাচ্ছে বাংলা হরফে বই ছাপা হোক। এন নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে এনসিটিবি।
সূত্র: সংবাদ