দুই মাস আগে সরকার রাজধানীর লালমাটিয়ার পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নিবন্ধন বাতিল করেছে। এখন সেই ভবনে পিস স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মকর্তাকে নিয়ে ‘রেড ব্রিজ’ নামে নতুন স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ভর্তিও করা হচ্ছে সাবেক পিস স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের।
নতুন নামের ওই স্কুলের ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের চার নেতা। চেয়ারম্যান হিসেবে স্থানীয় সাংসদ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের নাম স্কুলের কেউ কেউ বললেও তিনি বলেছেন, স্কুলটির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত নন।
স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছে, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি কার্যক্রম চলছে। চলতি মাস থেকেই ক্লাস শুরু হবে। গত বুধবার দুপুরে লালমাটিয়ার বি ব্লকে সরেজমিনে দেখা যায়, যে ভবনে পিস স্কুলের সাইনবোর্ড ছিল, সেখানে টাঙানো ‘রেড ব্রিজ স্কুল’-এর সাইনবোর্ড। পিস স্কুলের দুটি ভবনই ব্যবহার করছে রেড ব্রিজ স্কুল। সাবেক পিস স্কুলের শিক্ষর্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেড ব্রিজে ভর্তি করা হচ্ছে।
সন্তানকে ভর্তি করাতে আসা কয়েকজন অভিভাবক বললেন, তাঁদের বলা হয়েছে সরকার হঠাৎ পিস স্কুলের নিবন্ধন বাতিল করায় নাম বদল করা হয়েছে। স্কুলের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা গাজী শহিদুল হক এক অভিভাবককে বলছিলেন, ‘নানক স্যার (সাংসদ) এই স্কুলের চেয়ারম্যান। স্কুলের অধ্যক্ষ হলেন আবদুল্লাহ জামান, তিনি পিস স্কুলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ইতিমধ্যে স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। পিস স্কুল নিয়ে সমালোচনা হওয়ায় নানক স্যারকে আমাদের সঙ্গে রাখা হয়েছে।’
ওই দিন বিকেলে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গাজী শহিদুল হকের কাছে অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ জামানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ চিকিৎসা নিতে বিদেেশ গেছেন।
পরে যোগাযোগ করা হয় স্কুলের উপাধ্যক্ষ ডালিয়া নওরীনের সঙ্গে। তিনি পিস স্কুলেও একই দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন স্কুলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুর রহমান এবং চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক।’ পিস স্কুলের নিবন্ধন বাতিলের পর অন্য ব্যবস্থাপনায় নতুন স্কুলে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পিস স্কুল আর রেড ব্রিজের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। শুধু ব্যবস্থাপনায় কয়েকজন নতুন এসেছেন। অধ্যক্ষ অস্ট্রেলিয়ায় আছেন। তিনি বলেন, সিলেবাসের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রসঙ্গত, পিস স্কুলের সিলেবাস নিয়েই সমালোচনা ছিল।
জাহাঙ্গীর কবির নানক রেড ব্রিজ স্কুলের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না। পিস স্কুল তো বন্ধ করেছি আমি। তাহলে কেন আবার ওই স্কুলের নাম পাল্টে রাখা আরেক স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হব? ওই স্কুলের লোকজন আমার কাছে এসেছিলেন, কিন্তু আমি তাঁদের সঙ্গে থাকার বিষয়ে কোনো মতামত দিইনি।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেড ব্রিজ স্কুলের ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খান সাইফুল্লাহ, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনিছুর রহমান, ঝালকাঠি জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনিসুর রহমান এবং রাজধানীর বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জেড এম রানা। তাঁদের মধ্যে খান সাইফুল্লাহ স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা, আনিছুর রহমান চেয়ারম্যান, আনিসুর রহমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জেড এম রানা পরিচালক।
স্কুলের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এই চারজনের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেড এম রানা। তিনি এ-সংক্রান্ত কাগজপত্রও প্রথম আলোকে দিয়েছেন। তিনি বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক স্কুলের কোনো পদে নেই। তবে সহযোগিতা চাইলে করবেন বলেছেন।
রেড ব্রিজ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে খান সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, স্কুল থেকে জামায়াতপন্থীদের ধীরে ধীরে বাদ দেওয়া হবে। সাংসদ নানক স্কুলের উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন।
রেড ব্রিজ স্কুলে ভর্তি হওয়া সাবেক পিস স্কুলের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলের পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পরে তাঁরা সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন। পিস স্কুল বন্ধের সময় নতুন নামে স্কুল করার কথা বলা হয়েছিল। অভিভাবকদের একজন বলেন, ‘আমি পিস স্কুলের কর্মকর্তাদের অনেককেই রেড ব্রিজ স্কুলে দেখেছি। সাংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতারা রেড ব্রিজ স্কুলের ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন এমন কথা শুনে বাচ্চাদের ভর্তি করেছি। কারণ, পিস স্কুলের সিলেবাস নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে।’
জেড এম রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নতুন ব্যবস্থাপনায় রয়েছি। এটা ঠিক, একই স্থানে স্কুল রেখেছি। কেননা, নতুন জায়গায় ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ওই শিক্ষকদের না আনলে ছাত্রছাত্রীরা নতুনদের কাছে পড়তে চাইবে না। তবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করব। নতুন আসবাবও কিনব।’ কেন একটি বিতর্কিত স্কুলের জায়গায় স্কুল করলেন—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি এডুকেশন বিজনেস করি। একসঙ্গে ৬০০ থেকে ৭০০ ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে এ কারণে এখানে স্কুল করেছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সালে লালমাটিয়ার বি ব্লকের হাউস ৪/৯-এ পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের জুনিয়র সেকশন এবং হাউস ৫/৭-এ সিনিয়র সেকশনে ইংরেজি মাধ্যমে প্লে গ্রুপ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। সম্প্রতি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উগ্রবাদী শিক্ষা দেওয়া হয় বলে গোয়েন্দা সংস্থা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্য আসে।
এ ছাড়া গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলাকারী অন্তত দুজন জঙ্গি ভারতের ইসলামিক বক্তা জাকির নায়েকের বক্তব্যে প্ররোচিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠার পর দেশে পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ হয় ১১ জুলাই। এরপর পিস স্কুল বন্ধ করার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। পরে ৩ আগস্ট লালমাটিয়ার পিস স্কুলের নিবন্ধন বাতিল এবং সারা দেশে পিস স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ রয়েছে, কোথাও কোথাও নাম বদলে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সাবেক পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক খান মো. আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কারা নতুন ব্যবস্থাপনায় রয়েছেন তা তিনি জানেন না। তবে ওই স্কুল থেকে তিনিসহ দু-একজন বেরিয়ে এসেছেন।
সূত্র: প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর ২০১৬