প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ কি কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়?

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

১৯ নভেম্বর থেকে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রথম পরীক্ষায়ই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ইস্যুতে শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের উত্তেজনা রয়েছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, পরীক্ষায় নকল করার ছড়াছড়ি আমাদের বাকরুদ্ধ ও আশঙ্কিত করে তুলেছিল। এখন তা বন্ধ হয়েছে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই পুরনো শঙ্কা আরও ভয়াবহতা পেয়েছে। এখন আর কেবল ব্যক্তি শিক্ষার্থী নয়, এখন এই সর্বনাশা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক চক্র এবং শিক্ষক-অভিভাবকদের অনেকে। শিক্ষামন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চমহল এ বিষয়ে বিশেষ সরব থাকলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

আর এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এখন সরাসরি শিক্ষকের গায়ে আসতে শুরু করেছে। গত ১৬ নভেম্বর পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, আগে সরকারি ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি থাকলেও এখন সেটি নেই। তিনি বলেন, ‘যখনই শিক্ষকের হাতে প্রশ্ন গেল, তখনই নিরাপত্তা ব্যাহত হলো।’ অর্থাৎ প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে শিক্ষকদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর আগে ২৮ এপ্রিল তিনি ঢাকায় এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘কিছু শিক্ষক ক্লাসরুমে না পড়িয়ে বাড়িতে টাকার বিনিময়ে পড়ান। কেউ কেউ কোচিং বাণিজ্যে জড়িত। এরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। এদের চিহ্নিত করতে হবে।

অসৎ লোকদের শিক্ষকতা পেশায় বরদাশত করা হবে না। দেশে সব শিক্ষক ভালো নয়। ভালো, মানবিক ও বিবেকবানদের মাঝেও কিছু কুলাঙ্গার রয়েছে, যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে। পরীক্ষার দিন সকালে প্রশ্ন হাতে পেয়েই তা ফাঁস করে দিচ্ছে ওইসব শিক্ষক। তাহলে কীভাবে এ প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাব?’ শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই একমত হওয়া গেলেও বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, যেসব শিক্ষক এসব অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না? তাহলে কি এটি এক ধরনের ব্যর্থতা নয়?

আমরা প্রায়ই শিক্ষা নিয়ে নানা উন্নয়ন ও সংস্কারের কথা শুনে থাকি কিংবা বলে থাকি। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তবে গত কয়েক মাস আগে সরকার শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেটি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি-না সেটি নিয়ে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের নির্দেশ কিংবা পরিপত্র আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা আদৌ কি আমরা দেখেছি?

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যদি শিক্ষকরা জড়িতই থাকে, তাহলে কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না? অন্যদিকে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের বহুবার যথাযথভাবে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয় না- সেটিও একটি বড় প্রশ্ন।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা আগেও ঘটেছে; কিন্তু গত কয়েক বছরে তা বিস্ময় আর সহ্যের সীমাও অতিক্রম করেছে। অভিভাবক হিসেবে নিজে একবার বিষয়টি চিন্তা করে দেখুন, সারা বছর সততার সঙ্গে সন্তানকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করেছেন, সে নিষ্ঠার সঙ্গে লেখাপড়া করেছে, কিন্তু পরীক্ষার দিন সে জানতে পারছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তারই কোনো সহপাঠী ‘ভালো’ পরীক্ষা দিয়েছে। জানতে পারছে, তার সেই সহপাঠীরই হয়তো অভিভাবক, হয়তো শিক্ষক, হয়তো কোনো নিকটজনের ব্যবস্থা করেছেন! অনেক ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত অভিযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে এলেও তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। কারণ এড়িয়ে না গেলে পরীক্ষা বাতিল করে নতুনভাবে পরীক্ষা নিতে হবে। ফলে সৃষ্টি হবে নতুন বিড়ম্বনা। আর এমন বিড়ম্বনা এড়ানোর অজুহাতে অহরহ ঘটে চলেছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা।

উল্লেখ্য, এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ছিল। শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, প্রমাণ পেলে ওই পরীক্ষা বাতিল করা হবে। এর সহজ অর্থ একটাই, গণমাধ্যমগুলো মিথ্যা বলছে, গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু একবারও কি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে? এ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একটি ইউনিটে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত ছাড়াই উপাচার্য এ অভিযোগকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেন।

যেহেতু এসব মিথ্যা, যেহেতু এসব গুজব, অতএব যে কোনো ধরনের অভিযোগ ও প্রতিবাদ মূল্যহীন। জাতীয় সংসদে শিক্ষামন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তুলে আমাদের সবাইকে অসহায় করে তুলছে। কিন্তু এর প্রতিকার কেন আনতে পারছেন না- সে বিষয়ে আজ আমরাই ক্ষোভ প্রকাশ করছি।

শিক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিককালের বক্তব্যগুলো বিশ্নেষণ করলে লক্ষ্য করা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায় চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কেবল শিক্ষকদের ওপর। অথচ যে সমন্বিত চক্র শিক্ষকদের একাংশকেও এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছে, তাদের ব্যাপারে নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো তো বটেই, গ্রহণযোগ্য অনলাইন সংবাদমাধ্যমেও হাতেনাতে দেখানো হয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত সে রকম স্ট্ক্রিনশটও মিলছে। হয়তো তা এই প্রক্রিয়ার একটি খণ্ডিত চিত্র; কিন্তু সরকার আন্তরিক হলে এই সূত্রটুকু থেকেই কি সম্ভব নয় এর মূলোৎপাটন করা?

উল্লেখ্য, শিক্ষকদের ঢালাও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে অভিযুক্ত করার বিষয়টি কোনোভাবেই মানানসই নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতি বছরই ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন একাডেমিক পরীক্ষা হয়ে থাকে। কিন্তু দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কখনও কি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আমরা পাই? এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গর্বিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে যে, কোনো ধরনের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তো দূরে থাক- এ বিষয়ে সামান্যতম অভিযোগের খবরও আমরা পাই না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন সরাসরি শিক্ষকরা।

প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে শিক্ষকরা যুক্ত থাকেন। এমনকি পরীক্ষা নেওয়ার লক্ষ্যে কক্ষে দায়িত্বরত শিক্ষকদের হাতে আধঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মাধ্যমে কখনোই প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। তাহলে অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষা কিংবা চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস কেন হচ্ছে? তাহলে কি শুধুই শিক্ষকরাই দায়ী? নাকি অন্য কোনো রহস্য রয়েছে? কাজেই যথাযথ কর্তৃপক্ষ সমীপে প্রশ্ন রাখতে চাই, ঢালাওভাবে কাউকে দোষারোপ না করে যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে, প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তির আওতায় আনুন। আর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা কোচিং বাণিজ্যের প্রবণতা কমে আসবে।

সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028610229492188