প্রশ্ন ফাঁস: তদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি ফল প্রকাশ

ঢাবি প্রতিনিধি |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের প্রথম বর্ষ স্নাতক সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ থাকলেও বিষয়টি তদন্ত না করেই তড়িঘড়ি ফল প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল রবিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান এই ফল প্রকাশ করেন।

এই ইউনিটে পাসের হার ১৪.৩৫ শতাংশ।
জানা যায়, ‘ক’ ইউনিটে ৮২ হাজার শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ১৩ অক্টোবর। ফল প্রকাশ হয় ১৮ অক্টোবর দুপুরে। ‘খ’ ইউনিটে ২২ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা হয়, ফল প্রকাশ হয় ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে। ‘গ’ ইউনিটে ১৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা হয়, ফল প্রকাশ হয় ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়। ‘খ’ ও ‘গ’ ইউনিটের প্রতিটিতে পরীক্ষার্থী ছিল ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজারের মধ্যে। ‘ঘ’ ইউনিটে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭১ হাজার। গত ২০ অক্টোবর এই ইউনিটের পরীক্ষা হয়। দুই দিনের মধ্যে গতকাল দুপুরেই ফল দেওয়া হলো।

অথচ ‘ক’ ইউনিটে প্রায় সমসংখ্যক পরীক্ষার্থী থাকলেও ফল প্রকাশ করতে সময় লেগেছিল পাঁচ দিন।
ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যত্নসহকারে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করেছি। কিন্তু কোথাও এর কোনো প্রভাব লক্ষ করিনি। সর্বোপরি এই ফল সন্তোষজনক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অনুযায়ীই এই ফল হয়েছে। তবে যেসব অশুভ শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে ষড়যন্ত্র করছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। ’

গত শুক্রবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ৫৩টি এবং ক্যাম্পাসের বাইরে ৩৩টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষার আগে রাত ৩টার দিকে ইংরেজি অংশের ২৪টি প্রশ্ন ই-মেইলের মাধ্যমে প্রথমে পাওয়া যায়। এরপর পরীক্ষা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে ওই প্রশ্নের উত্তর নির্দিষ্ট শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে এসএমএস করে পাঠানো হয়। পরীক্ষার আগে সরেজমিনে গিয়ে মোবাইল ফোনে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর পড়তে দেখা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম। যুগ্ম সমন্বয়কারী ছিলেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইতুল ইসলাম এবং আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ। ডিনের নেতৃত্বে কোর কমিটিতে ছিলেন লোকপ্রশাসন বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক আখতার হুসাইন এবং অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক নাজমা বেগম। তবে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার পর ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার মূল সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন সাবেক ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া। পরে ডিন পরিবর্তন হলে মূল সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পান অধ্যাপক সাদেকা হালিম। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগে সমন্বয় কমিটির এক বা একাধিক সভা হওয়ার কথা থাকলেও নতুন ডিন প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই কমিটির কোনো সভা হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা জানান, কয়েকটি উপায়ে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যেতে পারে। চাইলে কোর কমিটির কেউ ফাঁস করে দিতে পারেন। যিনি প্রশ্নপত্র টাইপ করেন তিনিও ফাঁস করতে পারেন অথবা নজরদারির ঘাটতি থাকলে প্রেস থেকে প্যাকেট করার সময়ও প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে। আগের বছরগুলোতে পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে বা পরে প্রযুক্তির সাহায্যে প্রশ্ন বাইরে চলে আসার খবর থাকলেও পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন চলে আসার ঘটনা এবারই প্রথম।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একজন সহকারী রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে বিমানবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন জালিয়াতি, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের এবং চলতি বছর জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার পরে তাঁকে বদলির সুপারিশও ছিল। কিন্তু ডিন বদল হওয়ায় তাঁকে আর বদলি করা হয়নি। তাঁকে ঘিরেও রয়েছে সন্দেহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম। অন্য সময়ে পরীক্ষা শুরুর আগে-পরে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এবার যেহেতু প্রায় আট ঘণ্টা আগে হয়েছে, এখানে কোনো ষড়যন্ত্র থাকতেও পারে। আর অধ্যাপক আখতারুজ্জামান নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাঁকে একটা ঝামেলায় ফেলতেও একটি চক্র এ ধরনের কাজ করে থাকতে পারে। ’

এবার বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সম্মিলিত এই ‘ঘ’ ইউনিটে মোট ৯৮ হাজার ৫৪ জন ভর্তীচ্ছু আবেদন করেছিল। এদের মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭১ হাজার ৫৪৯ জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ১০ হাজার ২৭০ জন। সেই হিসাবে মোট পাসের হার ১৪.৩৫ শতাংশ। অনুত্তীর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা ৬১ হাজার ২৭৯। এই ইউনিটে মোট এক হাজার ৬১০টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানে এক হাজার ১৪৭টি, ব্যবসায় শিক্ষায় ৪১০টি এবং মানবিকে ৫৩টি।

পাস করা শিক্ষার্থীরা আগামী ১৩ নভেম্বর থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ওয়েবসাইটে বিস্তারিত ফরম ও বিষয় পছন্দক্রম ফরম পূরণ করতে পারবে। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কোটার ফরম ২৩ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিস থেকে সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পূরণ করে জমা দিতে হবে। ফল নিরীক্ষণের জন্য নির্ধারিত ফি প্রদান সাপেক্ষে গতকাল থেকে আগামী ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিসে আবেদন করা যাবে। আগামী ১ নভেম্বর অনুষদ অফিসে নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হবে।

গতকাল ফল প্রকাশের সময় উপস্থিত ছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন ও ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষার প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক সাদেকা হালিম, অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এনামউজ্জামান, প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রমুখ।

প্রত্যাখ্যান উপাচাযের্র : এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘পরীক্ষার আগের রাতে কোনোভাবেই প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। ফাঁস হয়েছে সকাল ১০টার পরে, যখন পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু সেটির প্রভাব পরীক্ষার্থীদের ওপর এবং পরীক্ষার ফলাফলে কোথাও পড়েনি। সে কারণে পুরো পরীক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান নষ্ট করতে পারি না। আর ফল স্থগিত রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই বিষয়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান, শিক্ষার্থীদের জীবন জড়িত। তবে আমরা তদন্ত করে দেখব কোন অশুভ শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে এমন গুজব ছড়াচ্ছে। ’ কেন্দ্রীয় প্রগতিশীল ছাত্র জোটের প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত ও তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা স্থগিত রাখার দাবি জানালে উপাচার্য তাঁর ওই অবস্থান ব্যক্ত বরেন। ছাত্র জোটের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে আসে। এর আগেই উপাচার্য কার্যালয়ে প্রবেশের মূল গেট তালাবদ্ধ রাখা হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে প্রক্টর গোলাম রব্বানী তাদের শান্ত করেন। পরে উপাচার্য এসে তাদের দাবি শোনেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘শেইম, শেইম’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরে উপাচার্য চলে গেলে এর প্রতিবাদে জোটের পক্ষ থেকে আজ দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে কর্মসূচি ঘোষণা করে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দেন ইমরান হাবিব রুমন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026941299438477