প্রসঙ্গ: কল্যাণ-অবসরের চাঁদা বৃদ্ধি

অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু |

অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারিদের কল্যাণ এবং অবসর বো‌র্ডের বিরাজমান সমস্যা সমাধা‌নের ল‌ক্ষ্যে সরকার কল্যাণ এবং অবসর বোর্ড শিক্ষক‌দের চাঁদা ৪ শতাংশ বৃদ্ধি ক‌রে‌ছে  (কল্যা‌ণে ২ শতাংশ  এবং অবস‌রে ২ শতাংশ)। কল্যাণ ট্রাস্টে ই‌তোম‌ধ্যে সরকারি গে‌জেট প্রকা‌শিত হ‌য়ে‌ছে। এনি‌য়ে পত্র প‌ত্রিকা ও সামা‌জিক যোগা‌যোগ মাধ্য‌মে বি‌ভিন্ন বক্তব্য প্রকা‌শিত হ‌চ্ছে। এ বিষয়ে জনম‌নে বিভ্রা‌ন্তির অবকাশ র‌য়ে‌ছে। অনেকে বিষয়‌টির ভুল ব্যাখ্যাও দি‌চ্ছেন। প্রকৃত ঘটনা হ‌লো বেসরকারি শিক্ষকরা সারাজীবন চাকরি ক‌রে শেষ জীব‌নে শূন্য হা‌তে বাড়ি ফির‌তেন। তা‌দের কোন পেনশ‌নের ব্যবস্থা ছিলনা। ছাত্র-ছাত্রী‌রা চাঁদা উ‌ঠিয়ে সেই টাকায় অবসর গ্রহনকারী শিক্ষ‌কের হা‌তে ছাতা, লাঠি, জায়নামাজ, তসবী, তু‌লে দি‌তেন। বঙ্গবন্ধু সরকার সর্ব প্রথম এদে‌শের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়কর‌ণের উদ্যোগ গ্রহন‌ ক‌রেন।

উল্লেখ‌্য যে, একজন ডিগ্রি ক‌লে‌জের অধ্যক্ষ অবসরকালীন কল্যাণ ও অবসর মোট ৫০ লাখ টাকা ও হাই স্কু‌লের প্রধান শিক্ষক ২৪ লাখ টাকা পায়। ১৯৭৩ সা‌লে বঙ্গবন্ধু এদে‌শের ৩৭ হাজার প্রাথ‌মিক বিদ্যাল‌য়ে কর্মরত ১ লাখ ৬২ হাজার শিক্ষ‌কের চাকরি জাতীয়করণ ক‌রেন। একই সা‌থে তি‌নি বেসরকারি হাইস্কু‌লের শিক্ষক‌দের জন্য ৭৫ টাকা এবং ক‌লেজ শিক্ষ‌কদের জন্য ১০০ টাকা বেতন ভাতা প্রবর্তন ক‌রেন। সেই সা‌লে বেসরকারি শিক্ষক‌দের জন্য কল্যাণ চালু করার উদ্যোগ গ্রহ‌ন ক‌রেন ।পঁচাত্ত‌রে বঙ্গবন্ধু‌কে হত্যার পর কল্যাণ ট্রাস্ট আর চালু হয়‌নি।

এ দে‌শের শিক্ষক‌দের দাবির প্রে‌ক্ষি‌তে ১৯৯০ সা‌লে কল্যাণ ট্রাস্ট চালু করা হয়। শিক্ষক‌দের বেতন থে‌কে প্র‌তি মা‌সে ২ শতাংশ চাঁদা কর্ত‌নের মাধ্য‌মে সংগৃহীত অর্থ থে‌কে কল্যাণ ট্রাস্ট চালু করা হয় এবং ছাত্র-ছাত্রী‌দের নিকট থে‌কে বাৎস‌রিক পাঁচ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। মাত্র ৬ মাস কল্যাণ ট্রা‌স্টের কার্যক্রম চালু থাকার পর ১৯৯১ সা‌লে কল্যাণ ট্রা‌স্টের কার্যক্রম বন্ধ ক‌রে দেওয়া হয়। ১৯৯১ সাল থে‌কে ’৯৬ সাল পর্যন্ত বিএন‌পি সরকার যত‌দিন ক্ষমতায় ছিল তত‌দিন কল্যাণ ট্রাস্ট বন্ধ ছিল। ১৯৯৬ সা‌লের নির্বাচ‌নে আ‌ওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ১৯৯৭ সা‌লে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আনুষ্ঠা‌নিকভা‌বে কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যক্রম চালু ক‌রেন। ৬ বছ‌র কল্যাণ ট্রাস্টের চাঁদা ক‌াটা বন্ধ থ‌াকায় কল্যাণ ফান্ড থে‌কে প্রায় দেড়শ’ কো‌টি টাকা ক‌মে যায়।

২০০১ সা‌লে বিএন‌পি পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সা‌লে জাতীয় সংস‌দে আইন পাশ ক‌রে ছাত্রছাত্রী‌দের নিকট থে‌কে আদায়কৃত বাৎস‌রিক পাঁচ টাকা চাঁদা বন্ধ ক‌রে দেওয়া হয়। এ খাত থে‌কে কল্যাণ ট্রা‌স্টের গত ১৫ বছ‌রে আরো প্রায় ১২৫ কো‌টি টাকা ক‌মে যায়। কল্যাণ ও অবসর আইন হ‌লো বেসরকারি শিক্ষকরা অব‌সরে যাবার সময় সর্ব‌শেষ যে স্কে‌লে বেতন পান সেই স্কেল অনুযায়ী তা‌কে কল্যাণ ও অবসর বো‌র্ডের পাওনা প‌রি‌শোধ কর‌তে হ‌বে। শিক্ষকদের স্কেল পরিবর্তনশীল বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে দুইটি পে-স্কেল দিয়েছে। এর ফলে ২০০৯ সালে শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে বেড়েছে ১০০ শতাংশ। স্কেল বৃদ্ধি পাওয়ায় আইন অনুযায়ী কল্যাণ এবং অবসর বোর্ডে শিক্ষকদের পাওনা এ দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে স্কেল দেওয়ার সময়ই কল্যাণ এবং অবসরের চাঁদা দ্বিগুন করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চাপ দেওয়া হয়ে‌ছিল।

আমরা শুধুমাত্র শিক্ষক‌দের উপর এ দায় না চাপ‌াতে চাপ সৃ‌ষ্টি ক‌রি। এ দি‌কে টাকার অভা‌বে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক‌দের কল্যাণ ও অবস‌রের দাবি পূরণ কর‌তে ৪/৫ বছর লে‌গে যা‌চ্ছিল। অসহায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক‌দের দাবি দ্রুত নিষ্প‌ত্তির ল‌ক্ষ্যে কল্যাণ এবং অবস‌রের বোর্ড সভায় বো‌র্ডের সকল সদস্যের মতাম‌তের ভি‌ত্তি‌তে কল্যাণ ট্রা‌স্টের চাঁদা ২ শতাংশ এবং অবসর বো‌র্ডের চাঁদা ২ শতাংশ বৃ‌দ্ধির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত সভায় স্বাধীনতা শিক্ষক প‌রিষদ, বাংলা‌দেশ শিক্ষক স‌মি‌তি, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য ফ্রন্ট, বাংলা‌দেশ ক‌লেজ বিশ্ব‌বিদ্যালয় শিক্ষক স‌মি‌তি, কা‌রিগ‌রি শিক্ষক স‌মি‌তির  প্র‌তি‌নি‌ধিরা উপ‌স্থিত ছি‌লেন।

শুধুমাত্র শিক্ষক‌দের উপর যা‌তে চাপ না প‌ড়ে এজন্য দফায় দফায় অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সভা ক‌রে। সর্ব‌শেষ গত বা‌জেটে কল্যাণ এবং অবস‌রের জন্য ৬৫০ কো‌টি এবং বর্তমান প্রস্তা‌বিত বা‌জে‌টে আরো ২০০ কো‌টি টাকা বরাদ্দ করা হয়। কল্যাণ ট্রা‌স্টের ২৭ বছরেও ই‌তিহাসে এটাই প্রথম সরকারি বা‌জেট। আমা‌দের পক্ষে একজন শিক্ষক অবসর গ্রহনের পর তিন মাসের মধ্যে যেন অনলাইন ব্যবস্থায় তাঁর পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া সেই লক্ষ নিয়ে আমরা কাজ করছি। এবার প্রায় দুই হাজার শিক্ষককে অনলাইন ব্যবস্থায় হজ্বের টাকা প্রদান করা হয়েছে।

সরকারি অনুদান আরো বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। প্রতি অর্থ বছরেই যেন বরাদ্দ থাকে সেই চেষ্টা চলছে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট থেকে আদায়কৃত চাঁদা পুনপ্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। একটি কথা আমরা শিক্ষকদের সকলেরই মনে রাখতে হবে আমরা সবাই একসময় অবসরে যাবো। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের কল্যাণ অবসরের টাকা সহজে পাবার জন্যই এই উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে।

আমরা বেসরকারি শিক্ষকদের সবার দাবি শিক্ষার বৈষম্য দূরীকরণে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ। শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কল্যাণ অবসর সহ সকল সমস্যা সমাধান হবে।

অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু: সাবেক ছাত্রনেতা, সদস্য সচিব, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049428939819336