প্রাথমিক শিক্ষা ৫ম শ্রেণী পর্যন্তই থাকছে

রাকিব উদ্দিন |

পাঁচ-ছয় বছর নানাভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণীতে উন্নীত করার চেষ্টা থেকে পিছু হটেছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী চালুর অনুমতিও বন্ধ থাকবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের আলোকে এই মন্ত্রণালয়ের অধীনন্থ শিক্ষাবোর্ডগুলোও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী চালুর অনুমতি বন্ধ রেখেছে। দেশের বেশকিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষাবোর্ডগুলোতে আবেদন করেছিল গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব আবেদন আর বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের আলোকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী বা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা এই ধরনের কিছু আবেদন পেয়েছি, যা ইন্সপেকশনের (স্কুলে ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করার মতো অবকাঠামো রয়েছে কী না-তার প্রতিবেদন করা) অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল। এখন সেগুলো পেন্ডিং (ঝুলে রাখা) থাকবে।’

তিনি আরও জানান, ‘এখন নতুন করে কোন স্কুলে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের অনুমতি দেয়া হলেও সেসব স্কুল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকবে। অর্থাৎ শিক্ষানীতি অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা আপাতত আগের মতোই থাকবে, ৮ম শ্রেণীতে উন্নীত হচ্ছে না।’

‘প্রাথমিক শিক্ষা ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে’- এই সিদ্ধান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গত ৮ অক্টোবর এক চিঠির মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর বাস্তবায়ন এবং ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত ১৬ মে’র এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। সভার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মন্ত্রিসভার পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রিসভার পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে প্রেরিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ৬ষ্ঠ শ্রেণী চালুর অনুমতি প্রদানের আবেদনসমূহ বিবেচনার সুযোগ নেই এবং প্রাথমিক শিক্ষা ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যা নির্দেশক্রমে অবহিত করা হলো।’

যদিও কীভাবে প্রস্তুতি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করা যায়, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঠিক করতে গত ১৬ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগের সচিব মো. আলমগীরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেন দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ কমিটি একবার বৈঠকে বসলেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি।

‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কমিটি’ গত ১৬ আগস্ট একটি সভা করেন। ওই সভায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ হবে নাকি ‘বেসিক এডুকেশন’ হবে তা নির্ধারণে জটিলতায় পড়েন দুই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। তাদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দুই মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণীতে উন্নীত করার প্রক্রিয়া থেকে পিছু হটেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবীর বলেন, ‘শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ না রাখায় ২০১৮ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অর্থের অভাবে মন্ত্রণালয়ও কোন পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এখন শুনছি, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২০২০ পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।’
তিনি জানান, ‘শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য এ খাতে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, আপাতত জিডিপির সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিলেও চলবে। সেটিও হচ্ছে না। উল্টো জাতীয় বাজেটে শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে একত্রে বরাদ্দ দেয়া হয়। এতে মূল শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও কমেছে। বর্তমানে জিডিপির ১ দশমিক ৯২ শতাংশ অর্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ রয়েছে।’

শিক্ষানীতিতে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পাঁচ বছর থেকে বৃদ্ধি করে আট বছর অর্থাৎ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ২০১৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করা আছে। সেই আলোকেই গত বছরের ১৬ মে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করে তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এর পর গত ৩০ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবকে একটি চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘ইতোপূর্বে নিম্ন মাধ্যমিক (৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী) পর্যায়ের যে সব কার্যক্রম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিষ্পন্ন হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা পূর্বের ন্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিষ্পন্ন হবে। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইতোমধ্যে প্রদত্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পাঠদানের অনুমতি/একাডেমিক স্বীকৃতি বহাল থাকবে। এমতাবস্থায়, বর্ণিত সিন্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইতিপূর্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে প্রেরিত নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানের অনুমতি/একাডেমিক স্বীকৃতি ও অতিরিক্ত শ্রেণী শাখা খোলা সংক্রান্ত প্রেরিত পত্রাদি ফেরত প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

এ ছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৩ সালে ৫০৩টি এবং ২০১৪ সালে ১২৪টি নিয়ে মোট ৬২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করা হলেও সেগুলোতে প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল মিলেনি। ওইসব স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চলে গেছে। কারণ ওইসব বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই বলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি ও মাদরাসার জেডিসি পরীক্ষা নেয়া হয় শিক্ষা বোর্ডের অধীনে, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ। তবে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হলে এই পরীক্ষা নিতে হবে বোর্ডের মাধ্যমেই। কারণ গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব শিক্ষাবোর্ড নেই। এসব বিষয়ের সমাধান না করে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণীতে উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেয়া হলে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলে শিক্ষা বিশ্লেষক ও শিক্ষকরা আশঙ্কা করছেন।

শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করতে হলে নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন, প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, জনবল, ব্যবস্থাপনা- সব কিছুই নতুন করে সাজাতে হবে। নিয়োগ দিতে হবে স্নাতক ও বিএড ডিগ্রিধারী শিক্ষক। কিন্তু ২০১০ সালে শিক্ষানীতি তৈরি করা হলেও এটি বাস্তবায়নে জাতীয় বাজেটে আলাদা কোন বরাদ্দ রাখা হয়নি।

এ ছাড়া ২০১২ সালে সারাদেশের মোট ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়, যাদের বেশিরভাগ শিক্ষকের ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের যোগ্যতা রয়েছে কী-না তা নিয়েও সন্দিহান শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.010539054870605