আখাউড়া উপজেলায় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি ) পরীক্ষার আগেই ঝরে পড়েছে ৮৯ শিক্ষার্থী। ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২ জন ছাত্রী, এদের মধ্যে ২০ জনই বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও বাল্য বিয়ের কারণে অকালেই শিক্ষা জীবন থেকে ঝড়ে পড়েছে এসব শিক্ষার্থী। দৈনিকশিক্ষার পক্ষ থেকে পরীক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ অনুসন্ধান করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, এ বছর আখাউড়া উপজেলার ১৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২ হাজার ৭৪০ জন এবং ৬টি দাখিল মাদরাসার ৩০৬ জন পরীক্ষার্থী ছিল। এসব পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮৯ জন ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এদের মধ্যে বিদ্যালয়ের ৫০ জন এবং মাদরাসার ৩৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছিল। প্রবেশপত্রও পৌঁছেছিল স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তারা প্রবেশপত্র সংগ্রহ করেনি এবং পরীক্ষায়ও অংশ নেয়নি। উপজেলার একটি বিদ্যালয় ছাড়া বাকী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই কম-বেশি ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়েছে।
সরজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পারিবারিক অস্বছলতার কারণে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে অনেক ছাত্রছাত্রী। পরীক্ষায় অনুপস্থিত ৪২ ছাত্রীর মধ্যে ২০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে পরীক্ষার শুরু হওয়ার আগেই। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা এখন বই-খাতা রেখে স্বামী- সংসার নিয়ে ব্যস্ত। পরিবারের অস্বচ্ছলতা ও শারীরিক অসুস্থতার কারনেও কিছু কিছু ছাত্রীর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারণে কম বয়সী মেয়েদের শিক্ষা জীবনের ইতি ঘটেছে।
উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের আমোদাবাদ শাহআলম উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ৫ ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এদের মধ্যে ৩ জনের বিয়ে হয়ে গেছে পরীক্ষার আগেই। কল্লা শহীদ দাখিল মাদ্রাসা, নাছরীন নবী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও দেবগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই ২ জন করে ছাত্রীর লেখাপড়ার ছেদ ঘটেছে বাল্য বিয়ের কারণে। এছাড়া উপজেলার আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীসহ ২০ জনের বাল্য বিয়ের কারণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
জেডিসি পরীক্ষায় উপজেলার সবচেয়ে বেশি ১৮ জন ছাত্রছাত্রী ঝরে পড়েছে রাণীখার এস.আই. বি.জি আলিম মাদ্রাসা থেকে। এ মাদ্রাসার ১৬ ছাত্র ও ২ জন ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ মাওলানা মো: তাজুল ইসলাম বলেন, এ বছর ভাল প্রস্তুতি না থাকায় ওই প্রতিষ্ঠানের ১৮ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়নি। আগামী বছর ভাল প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিবে। ছাত্রীদের বিয়ে হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু নিশ্চিত নন।
মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়েছে ৮ ছাত্রী ও ২ ছাত্র। মোগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শশাঙ্ক কুমার রায় জানান, ১০জন ছাত্রছাত্রী পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করেনি। ছাত্রীদের বিয়ে হয়েছে বলে তিনি ধারণা করছেন।
তিনি বলেন, অভিভাবকরা গোপনে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন। তাই আমাদের কিছু করার থাকে না।
উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের এক অভিভাবক জানান, ভাল পাত্র পাওয়ায় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। মাথা থেকে দুশ্চিন্তা কমেছে বলে তিনি জানান।
আরেক ছাত্রীর মা জানান, মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে অনেক বড় ঘরে বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু পাশের বাড়ির এক বখাটে ছেলে তার মেয়েকে প্রায়ই রাস্তা-ঘাটে বিরক্ত করতো। তাই পরিবারের মান সম্মানের কথা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
আমোদাবাদ শাহ আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজী মো: তারেক বলেন, আমরা সব সময়ই অভিভাবকদেরকে পরামর্শ দেই বাল্য বিয়ে যাতে না দেয়। কিন্তু আমাদের অগোচরে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তা রোধ করার কোন উপায় থাকে না।
এ ব্যাপারে নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী আবুল হাছান বলেন, জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী কেউ বিবাহ যোগ্য হলে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার ব্যাপারে আমাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা যদি সঠিক ভাবে যাচাই বাছাই করে জন্ম নিবন্ধন সরবরাহ করেন তাহলে বাল্য বিবাহ কমিয়ে আনা সম্ভব।
আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কাজী মো: ইউসুফ বলেন, দরিদ্র পরিবারের মেয়েদেরই বাল্য বিয়ে হয় বেশি। আর্থিক অভাব অনটনের কারনে অনেক সময় বাবা মা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে চায়।
আখাউড়া নাছরীন নবী বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা কাজী সাফিয়া খাতুন বলেন, জেএসসি পরীক্ষার আগে মেয়ে শিক্ষার্থীদের বিয়ে হয়ে যাওয়া নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক। এতেই বুঝা যায় সমাজে বাল্য বিয়ে এখনো বিদ্যমান।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: দেলোয়ার হোসেন দৈনিকশিক্ষাকে বলেন, বাল্য বিয়ের জন তিনি অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, সরকার মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিনা মূল্যে বই দিচ্ছে, উপ-বৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করছে। কিন্তু অভিভাবকরা গোপনে বিয়ে দেওয়ায় তা রোধ করা সম্ভব হয় না। বাল্য বিয়ে রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি সতর্ক থাকার প্রয়োজন বলে তিনি বলেন।