সমুদ্র নিয়ন্ত্রণবিষয়ক যৌথ গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিষয়ে সোমবার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হইয়াছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ে। এই সমঝোতা স্মারকের আওতায় দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থী-শিক্ষক বিনিময়, তথ্য-উপাত্ত আদান-প্রদান করিবে। ইহা ছাড়া সমুদ্র ও উপকূল বিষয়ে যৌথ সম্মেলন, সেমিনার, স্বল্পমেয়াদি কোর্স ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হইবে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক অধ্যয়ন ইহাই প্রথম নহে।
বহু পূর্বেই ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংক্রান্ত বিভাগের যাত্রা শুরু হইয়াছিল, যাহার পরিসর ও মাত্রা বৃদ্ধি পাইয়া বর্তমানে সমুদ্র ও মত্স্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট আকার ধারণ করিয়াছে। ইহা ছাড়া নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নূতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সমুদ্র ও মত্স্যবিজ্ঞান বিভাগ চালু হইয়াছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা রহিয়াছে সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার। এইদিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপিত হইয়াছে রামু উপজেলার পেচারদ্বীপে।
সমুদ্রবিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণার এই উদ্যোগগুলি সাধুবাদ পাইবার যোগ্য। বাংলাদেশের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ইহা অতীব প্রয়োজনীয়ও বটে। বাংলাদেশ নানান সম্পদে সমৃদ্ধ। খনিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্য না থাকিলেও কৃষি ও পানিসম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। অবশ্য সমুদ্রসম্পদে যে বাংলাদেশ কতোটা সমৃদ্ধ তাহা যেন আমরা ভালো করিয়া অনুধাবনই করিতে পারি নাই এতকাল! পৃথিবীর অনেক দেশেই সমুদ্রসম্পদ নাই, বাংলাদেশ এই সম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। কিন্তু এই সম্পদ যথাযথভাবে কাজে লাগাইয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাহা সম্পৃক্ত করিতে পারি নাই আমরা। এক সময় পরিবেশবান্ধব ‘গ্রিন ইকোনমি’র কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু এখন ‘ব্লু ইকোনমি’ জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। ইহার অর্থ হইল সমুদ্রকে ঘিরিয়া অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও কার্যক্রম। সমুদ্রসম্পদ—যেমন মত্স্য, পরিবেশবান্ধব সমুদ্রশিল্প (যেমন বন্দর স্থাপনা ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প), খনিজ সম্পদ (তেল-গ্যাস), এমনকি সামুদ্রিক বায়ু-ঢেউ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সমুদ্রতলের প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠা শিল্প-বাণিজ্যকে ব্লু ইকোনমি বলিয়া সংজ্ঞায়িত করা হইয়া থাকে।
আমরা এই সম্পদ আহরণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এখনও পিছাইয়া আছি, যদিও সমুদ্রসম্পদে অন্যদের তুলনায় তেমন পিছাইয়া নাই। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করিয়া বাংলাদেশ আগাইয়া যাইতেছে। সমুদ্রের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হইতে পারে। এইজন্য আমাদের একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়া তাহার অধীনে সমুদ্রসম্পদ মজুদের তথ্যভাণ্ডার গড়িয়া তুলিতে হইবে এবং এই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করিয়া কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের রূপরেখা দাঁড় করাইতে হইবে। পাশাপাশি ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা ও গবেষণা বেগবান করিতে হইবে যাহাতে নীতিনির্ধারকদের নিকট উহা যথাযথ গুরুত্ব পায়। উপরন্তু, এই পুরা প্রক্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানগত্ আলোচনা-পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজন বিদ্যায়তনিক চর্চা-গবেষণার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এই সংক্রান্ত অধ্যয়ন ও পাঠক্রম চালু করিবার উদ্যোগকে আমরা তাই স্বাগত জানাই।
সৌজন্যে: দৈনিক ইত্তেফাক