বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষক ও অভিভাবকের করণীয়

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

একটি জাতির পুনঃগঠন ও সমৃদ্ধির জন্য কিশোররা মূল সম্পদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে ২৮ মিলিয়ন কিশোর আছে। তাদের মধ্যে ১৩.৭ মিলিয়ন মেয়ে এবং ১৪.৩ মিলিয়ন ছেলে। আর কিশোরদের ব্যাপক অংশই শিক্ষার্থী। বাল্য ও যৌবনের অন্তবর্তী দ্রুত পরিবর্তনশীল কালই বয়ঃসন্ধিকাল। মনোবিজ্ঞানী আর্নেস্ট জোন্স এর মতে বয়ঃসন্ধিকালের সময়সীমা ১৩ থেকে ১৮ বছর।

আবার মনোবিজ্ঞানী ই. হারলকের মতে বয়ঃসন্ধিকালের ব্যপ্তিকাল ১২ হতে ২১ বছর। উষ্ণম-লীয় দেশ হিসেবে এবং আকাশ সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশে উল্লিখিত বয়সের আগেও বয়ঃসন্ধিকালের বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। তবে যে মতই গ্রহণ করা হোক না কেন বয়ঃসন্ধিকাল জীবনের সন্ধিলগ্ন এবং যে কোন সন্ধিলগ্ন পরিবর্তনের আভাস নিয়ে আসে। বয়ঃসন্ধিকালে দৈহিক বিকাশ ও পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক বিকাশও প্রায় সমান্তরালভাবে চলে। এছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরের প্রাক্ষোভিক ও সামাজিক বিকাশেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বয়ঃসন্ধিকালই একজন ব্যক্তিকে যৌন পরিণতির দিকে ধাবিত করে শারীরিক, মানসিক ও প্রাক্ষোভিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের ভিত্তিতে বয়স্ক ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করে।

বয়ঃসন্ধিকালের আগমনে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তন ঘটে। এ অবস্থাকে মনোবিজ্ঞানীরা আকস্মিক বর্ধন বলে থাকেন। তবে এ বৃদ্ধি বয়ঃসন্ধিকালের শেষের দিকে আবার কমে যায়। বয়ঃসন্ধিকালে একজন মানবের সহজাত প্রবৃত্তিগুলো ক্রমশ বিকাশ লাভ ও পূর্ণতা লাভ করে। ব্যক্তির সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে পরিবেশের বিভিন্ন শক্তির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয় এবং ব্যক্তিসত্ত্বার বিভিন্ন দিকগুলোর ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। এ সময় অনুভূতি, আবেগ ও সামাজিক সচেতনতা বিকাশ লাভ করে। বয়ঃসন্ধিকালের একজন কিশোর বা কিশোরী শিশুও নয় আবার বয়স্কও নয়। সে এক অদ্ভুত দশা।

এ বয়সের কিশোর-কিশোরীরা জীবন ও জগতকে জানতে চায়। মনোবিজ্ঞানীরা বয়ঃসন্ধিকালের এ সময়কে ঝড়-ঝঞ্জা ও সমস্যা-সংকুল কাল বলে মনে করেন। বয়ঃসন্ধিকালে দেহের মাংসপেশী, হাড়, গ্রন্থি, মস্তিষ্ক, হৃৎপিন্ড, বাকযন্ত্র, শরীরের ওজন ও দৈর্ঘ্য বাড়ে। এ সময় রক্ত সঞ্চালন, শ্বাস-প্রশ্বাস ও পাকস্থলীর ক্ষমতা বাড়ে।

মুখমন্ডল ও কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসে। ছেলেদের দাড়ি, গোঁফ দেখা দেয় এবং হাত-পা ও বুক লোমশ হয়ে উঠে। ছেলেদের স্বপ্নদোষ শুরু হয়। মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়, বক্ষ উন্নত হয় এবং কোমড় মোটা হতে থাকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে যৌন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ ঘটতে থাকে এবং যৌন ইন্দ্রিয়ের পূর্ণতার মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে। ছেলেমেয়ে উভয়েই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ বোধ করে। কখনো কখনো প্রেমের সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে এবং হতাশা ও কষ্ট হতে মুক্তি পেতে বহুতল ভবনের ছাদ হতে লাফিয়ে পড়ে, গলায় দড়ি দিয়ে, ঘুমের ওষুধ খেয়ে এবং বিষ পান করে আত্মহননের পথও বেছে নেয়।

বয়ঃসন্ধিকালের দৈহিক পরিবর্তন কিশোর মনে বিপর্যয় আনে এবং চলনের ও মেলামেশার স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়ে যায়। এ সময় তারা নিঃসঙ্গ বোধ করে এবং আত্মসচেতন, ভাবপ্রবণ ও অন্তর্মুখী হয়ে উঠে। আজকাল ইন্টারনেট ও ফেসবুক এ বয়সের ছেলেমেয়েদের ভয়ানকভাবে প্রভাবিত করছে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে মেয়েদের বর্ধনের হার সমান হয় না। বয়ঃসন্ধিকালের প্রথম দিকে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বৃদ্ধি বেশি হয়। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের শেষ ধাপে ছেলেদের উচ্চতা ও ওজন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের ছাড়িয়ে যায়।

এ সময় বুদ্ধিবৃত্তি পূর্ণ হয়। চিন্তাশক্তি ও যুক্তিশক্তির বিকাশ ঘটে। বিমূর্ত ভাববস্তুর উপলব্ধি এবং চিন্তন ও অনুমিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জন করার মানসিক শক্তিও বয়ঃসন্ধিকালে অর্জিত হয়। ন্যায়-অন্যায় উপলব্ধি করার ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। কৌতূহল প্রবৃত্তি বিকশিত হয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন জ্ঞান লাভের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সৃজনশীল শক্তির বিকাশ ঘটে। এ সময় নিজেকে বোঝা ও মূল্যায়ন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বয়ঃসন্ধিকালের প্রাক্ষোভমূলক আচরণ লক্ষণীয়। এ সময় ভালোবাসা, স্নেহ, ঘৃণা, রাগ, ভয় ও দুশ্চিন্তার ভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আত্মপ্রকাশ করে। দৈহিক পরিবর্তনের কারণে কিশোর-কিশোরীরা কখনও লজ্জিত বা কখনও আনন্দিত থাকে। এ বয়সের কিশোর-কিশোরীরা কখনও আক্রমণাত্মক, কখনও মনমরা হয়ে থাকে। এছাড়া আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব এ বয়সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এসব আবেগ কখনও কখনও সংঘাতের রূপ নেয়। দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে কিশোর অনেক সময় অসহায় বোধ করে।

অনেক ক্ষেত্রে পরিবার উপযুক্ত মর্যাদা দেয় না। আবার কোন কোন সময় পরিবারের সদস্যদের বকাবকি ও নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে কিশোররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। হঠাৎ করে এরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। অনেক সময় মা-বাবার আদেশ-উপদেশকেও গ্রাহ্য করতে চায় না। বয়ঃসন্ধিকালের বিমূর্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে সেন্টিমেন্ট ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।

এ বয়সের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- বন্ধু নির্বাচন। মা-বাবার চেয়ে বন্ধুদের কথাকেই বেশি মূল্যবান মনে করে বয়ঃসন্ধিকালের কিশোররা। এছাড়াও এরা একাকী ঘরে দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতে চায়। ফ্যাশন সচেতন হয়ে উঠে। হঠাৎ করে রেগে যায়। নির্ঘুম রজনী কাটায়। ঠিকমত খেতে চায় না। কখনো কখনো হতাশা কাটাতে মাদকদ্রব্য, ফেসবুক, ইন্টারনেট ও পর্নো ছবিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। শুধু তাই না এদের অনেকেই অনিরাপদ দৈহিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে। ফলে পড়ালেখার চরম অবনতির পাশাপাশি পুরো জীবনটাই সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেঙে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন। ধ্বংস হয়ে যায় সম্ভাবনাময় একটি কিশোরের জীবন।

কাজেই এ কথা অবশ্যই বলা যায় যে, বয়ঃসন্ধিকাল মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিলম্বে হলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তথা বাংলাদেশ সরকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের উপর অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালনের কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ শ্রেণী পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষকরা এ স্তরের শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেন। পাশাপাশি আলোচিত স্তরের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকাও আবশ্যক। হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও অভিভাবকদের পর্যাপ্ত সময় রাখা প্রয়োজন সন্তানের জন্য। সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা ও সুস্থ বিনোদনে অভ্যস্ত করা অত্যন্ত ফলদায়ক।

ওদের সঙ্গে খবরদারি ও অহেতুক নজরদারি পরিহার করা দরকার। ওদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া দরকার। জোর করে কোন কিছু চাপিয়ে ভালো ফল আশা করা যায় না। অতিরিক্ত আদর ও শাসন দুটোই ক্ষতির কারণ। নিজের জীবনের পেছনের দিকে তাকিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা অনেকটাই বোঝা সম্ভব। কারণ, জীবন থেকে নেয়া শিক্ষার কোন বিকল্প নেই।

প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট স্তরের শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহানুভূতিশীল আচরণ। কারণ, এদের দরদী ও বন্ধুত্বপূর্ণ ভূমিকা নতুন করে সাজাতে পারে একজন কিশোরের জীবন। আবার বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা ও নেতিবাচক মনোভাব কিশোর-কিশোরীদের করে দিতে পারে দিশেহারা এবং উদ্ভ্রান্ত। এতে হতাশার সাগরে ডুবে কিশোর-কিশোরীরা চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে।

[লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, মানিকগঞ্জ]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026328563690186