ভুল সংশোধন হলেও সাম্প্রদায়িকীকরণমুক্ত হচ্ছে না পাঠ্য বই

শরীফুল আলম সুমন |

চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্য বইয়ে ছিল ভুলের ছড়াছড়ি। একই সঙ্গে পাঠ্য বইয়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িকীকরণও হয়। এক বছরেই ২৯টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধে পরিবর্তন আনা হয়। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী লেখকদের লেখাই বেশি বাদ দেওয়া হয়। ভুল আর সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবরই ছিল নিশ্চুপ। এ অবস্থায় আগামী বছরের পাঠ্য বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রণয়নপ্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। তাতে চলতি বছরের ভুলগুলো সংশোধন হলেও সাম্প্রদায়িকীকরণ থাকছেই।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানায়, চলতি বছরের পাঠ্য বইয়ে যেসব বড় ভুল রয়েছে সেগুলোর শুদ্ধিপত্র গত ১৮ মে দেওয়া হয়েছে। এবারের বইয়ে যেসব ভুল ধরা পড়েছে আগামী বছরের পাঠ্য বইয়ে সেগুলোর পাশাপাশি নতুন কোনো ভুল থাকলে সেগুলোও সংশোধন করা হবে।

এবার প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘আ’-তে ‘আম খাই’য়ের ছবিতে দেওয়া হয়েছিল ছাগল গাছে উঠে আম খায়, যা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। আগামী বছরের বইয়ে ছাগলকে গাছ থেকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে তাতে বিতর্ক এড়ানো যাবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম খাওয়ার দৃশ্যে কেন ছাগলকেই রাখতে হবে? আর ছাগল গাছের নিচে সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকলেও কি আম খেতে পারবে?

একই বইয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ও’-তে ‘ওড়না চাই’। এর সঙ্গে একটি কন্যাশিশুর ছবি দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। নতুন পাঠ্য বইয়ে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে। আগামী বছরের বইয়ে ‘ও’-তে দেওয়া হবে ‘ওজন নাও’। এবার তৃতীয় শ্রেণির হিন্দুধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ইংরেজি ভার্সনের বইয়ের পেছনের কভারে আঘাত দেওয়া অর্থে ‘Heart’ বানান ছাপা হয়েছে। আগামী বছর তা সংশোধন করে ‘Hurt’ করা হচ্ছে।

এবার তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটিতে প্রায় লাইনে লাইনেই ছিল ভুল। আগামী বছর তা সংশোধন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ২০০১ সালে কলকাতার ভারবি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত সুমিতা চক্রবর্তী সম্পাদিত কুসুমকুমারী দাশের কবিতার বইকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘সমুদ’ বানান ঠিক করে সমুদ্র এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ‘ঘোষনা’ বানান ঠিক করে ঘোষণা করা হচ্ছে। তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মায়ের নাম সংশোধন করে সায়েরা খাতুন লেখা হচ্ছে। প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘মৌ’ বানান ঠিক করে মউ লেখা হচ্ছে।

জানা যায়, দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পাঠ্য বই থেকে ২০১২ সালে যে বিষয়গুলো বাদ পড়েছিল তার সবই আবার ফিরে এসেছিল চলতি বছরের বইয়ে। ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা সংগঠন হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যপুস্তকের এই সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করে। ওই বছরের শুরুতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময়ে ইসলামী ছাত্রশিবির পরিচালিত ফেসবুক পেজ বাঁশের কেল্লায় একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামী ভাবধারার লেখা বাদ পড়েছে এবং ‘হিন্দু লেখক’ ও ‘হিন্দুত্ববাদী’ লেখা যুক্ত হয়েছে বলে দাবি করে তারা। পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। ইসলামী ভাবধারার ১৭টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়েছে বলে বারবার তারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে লিখিতভাবে জানায়। তাদের দাবি অনুযায়ী, হিন্দুত্ববাদসংশ্লিষ্ট ১২টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের বইয়ে ওই ২৯টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধেই রদবদল হয়েছে, যা আগামী বছর অর্থাৎ ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্য বইয়েও বহাল থাকছে।

গত এপ্রিলে নবম-দশম শ্রেণির ১২টি বই সহজ করার জন্য ১২টি কমিটি করা হয়। এ জন্য দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বইগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান, অর্থনীতি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় এবং ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা। কমিটি তাদের কাজ প্রায় শেষ করেছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি বইগুলো এনসিটিতে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। শিক্ষাবিদরা বইগুলো সহজপাঠ্য ও ভুল সংশোধনের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকীকরণ মুক্ত করারও প্রস্তাব দেবেন বলে জানা যায়।

তবে নাম প্রকাশ না করে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘যে ১২টি বই সুখপাঠ্য করা হচ্ছে সেগুলো এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ব্রেইল বই বাদে অন্য সব বইয়ের পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হয়েছে। চলতি মাসেই অনেক বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেওয়া হবে। এগুলোর যে পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত হয়েছে সেখানে সাম্প্রদায়িকীকরণের যে অভিযোগ তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। আর যে ১২টি বই সুখপাঠ্য করা হচ্ছে সেগুলোর পাণ্ডুলিপিও চলতি মাসে চূড়ান্ত করতে হবে। নয়তো যথাসময়ে বই পৌঁছানো সম্ভব হবে না। আগামী বছরের বইয়ে ভুল সংশোধন ছাড়া বড় কোনো পরিবর্তন থাকছে না। ’

জানা যায়, যেকোনো বইয়ে গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধ পরিবর্তন করতে হলে ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটির (এনসিসি) অনুমোদন লাগে। এখানে এনসিটিবির একার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। আর এনসিসি কমিটিও কোনো পরিবর্তন করলে তা সাধারণত মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই করে থাকে। চলতি শিক্ষাবর্ষের বইয়েও এনসিসি কমিটির অনুমোদন রয়েছে। আর আগামী শিক্ষাবর্ষে বেশির ভাগ বইয়েরই পাণ্ডুলিপির চূড়ান্ত অনুমোদন হয়ে গেছে। চলতি মাসে এনসিসি কমিটির সভার কোনো তারিখ নেই। তাই আগামী বছরের বইও সাম্প্রদায়িকীকরণ মুক্ত হচ্ছে না।

এনসিটিবির সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ‘প্রতিবছরই আমরা ভুলত্রুটি সংশোধন করি। তবে এবার আমরা স্পেশাল কেয়ার নেওয়ার চেষ্টা করছি। আশা করছি যতটা সম্ভব নির্ভুল বই দিতে পারব। আর চলতি বইয়ে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কথা হয়নি। আগামী বছরের বইয়ে কনটেন্ট চেঞ্জের সম্ভাবনা কম। আর এ বিষয়ে এনসিটিবির সিদ্ধান্ত নেওয়ারও ক্ষমতা নেই। এই সিদ্ধান্তের দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। নবম-দশম শ্রেণির যে ১২টি বই সুখপাঠ্য করা হয়েছে সেগুলো বাদে অন্যান্য প্রায় সব বইয়ের পাণ্ডুলিপিও প্রায় চূড়ান্ত। ফলে এগুলোর কোনো কনটেন্টে পরিবর্তনের সুযোগ নেই বললেই চলে। ’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049121379852295