মনের আনন্দে পড়

হোসনে আরা বেগম |

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন মনের আনন্দে জাতীয় দিবসগুলো উদযাপন করতাম। বিশেষ করে স্কুলঘর লাল, নীল কাগজ দিয়ে সাজিয়ে তুলতাম। একটা উত্সবমুখর পরিবেশে সকালটা শুরু হতো। পরিষ্কার পাটভাঙা জামাকাপড় পরে স্কুলে যাওয়ার আনন্দই ছিল অন্যরকম।

বর্তমানে সারা দেশে একই দিনে ১ জানুয়ারিতে সরকারি তত্ত্বাবধানে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে বই বিতরণ উত্সব হয়। এ উত্সবের দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়।

আমাদের শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই এক ও অভিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সরকার তাই সারা দেশে এই দুই স্তরে বিনামূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বই বিতরণ সরকারের একটা বিরাট সাফল্য। সরকারের এই সাফল্যকে শ্রদ্ধা জানিয়ে অন্যান্য জাতীয় দিবসের মতো প্রতি বছর ১ জানুয়ারি ক্যালেন্ডারের পাতায় ‘বই উপহার দিবস’ ছাপিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা মনে-প্রাণে এই দিবসটির জন্য অপেক্ষা করবে। ‘বই উপহার দিবসে’ শুধু শিক্ষার্থী কেন—এটা ছড়িয়ে দেওয়া হোক সবার মাঝে। এ দিবসে প্রিয়জন প্রিয়জনকে, বন্ধু বন্ধুকে একটা বই উপহার দিতে পারে। তাহলে বইয়ের প্রতি গোটা জাতি আগ্রহান্বিত হয়ে ১ জানুয়ারি সারা দেশে উত্সবের আমেজ ছড়িয়ে দেবে। এমনিভাবে বই উত্সবে যোগ হতে পারে একটা নতুন মাত্রা।

এবার ২০১৮ সালে বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মাথায় ক্যাপ পড়ে লাল, নীল ফিতা উড়িয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বই উত্সব করেছে। সারা দেশে প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থী উত্সবমুখর পরিবেশে নতুন বই হাতে পায়। এটা একদিকে যেমন সরকারের একটা বিরাট অর্জন, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের একটা নির্মল মহোত্সব।

বিনামূল্যে বই বিতরণ ২০০৯ সাল থেকে শুরু হলেও এ ধরনের উত্সব তখন ছিল না। ২০১০ সালে আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষামন্ত্রী বিনামূল্যে বই বিতরণ উত্সবের উদ্বোধন করেন। প্রথমে কথা ছিল, মন্ত্রী মহোদয় দুয়েকটা ক্লাসে বই দিয়ে চলে যাবেন। তারপর বিভিন্ন শ্রেণিতে শ্রেণিশিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেবেন। মন্ত্রীর কাছ থেকে বই গ্রহণ করা বা বছরের শুরুতে মন্ত্রীর কাছ থেকে দুটো ভালো কথা শোনা থেকে বঞ্চিত হবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তাই তাড়াতাড়ি ছোট-খাট একটা স্টেজ বানানো হলো। স্টেজের সামনে ছাত্রীদের শ্রেণিভিত্তিক ছোট থেকে বড় সাজিয়ে ম্যাট বিছিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো। এতে কর্তা ব্যক্তিরা খুশি হলেন না। তাদের ধারণা, মন্ত্রী মহোদয় রাগ করবেন। কারণ, খুব অল্প সময়ের জন্যে এসে তিনি অনাড়ম্বর বই দিয়ে চলে যাবেন। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তাকে বুঝাবার চেষ্টা করা হলো, এতে শিক্ষার্থীরা আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারলেন না। বরং শিক্ষার্থীদের ক্লাসে তুলে দিতে বললেন। আমাদের বানানো স্টেজটাও ভেঙে ফেলার উপক্রম। এদিকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মন্ত্রী মহোদয় চলে এলেন। তাঁকে সংক্ষেপে বলা হলো, শিক্ষার্থীদের নতুন বই পাওয়ার আনন্দের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর মূল্যবান বক্তব্য তাদের অনুপ্রাণিত করবে। তিনি সম্মত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আবার মাঠে এনে বসিয়ে দেওয়া হলো।

সেদিন ছিল ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি। মন্ত্রী মহোদয় বক্তৃতা দিলেন। শিক্ষার্থীদের নতুন বই পেয়ে ভালো করে পড়াশোনা করতে বললেন। পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরে তিনি আরো বললেন, তাদেরকে একটি দক্ষ, দেশপ্রেমিক, আত্মনির্ভরশীল, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন,শ্রমনিষ্ঠ সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার জন্যে।

শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই দিয়ে যদি প্রত্যেকটা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে ছোট্ট একটা উপদেশবাণী দেওয়া যায়, মনের আনন্দে পড়, তাহলে শিক্ষার্থীরা নির্দ্বিধায় মনের আনন্দে পড়াশোনা শুরু করবে। এখন প্রশ্ন হলো, আনন্দ পাওয়ার মতো যথাযথ উপাদান বইয়ে আছে তো? বইটি সম্পূর্ণ নির্ভুল হয়েছে কি? বয়স, মেধা অনুযায়ী যতটুকু বিষয়বস্তু থাকার কথা, তার অতিরিক্ত বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মাথার বোঝা করা হয়নি তো? এত সব প্রশ্নের উত্তর বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সঠিক বিষয়টি খুঁজে বের করতে হবে। তারপরই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে হবে। ভুল-ত্রুটিসহ কোনো এরোপ্লেন তো আকাশে উড়িয়ে দেওয়া যায় না? পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করেই আকাশে প্লেন উড়ানো হয়। তেমনিভাবে বছরের শুরুতেই পরবর্তী বছরে যে-বই পাঠ্য করা হবে, সে বই ভুল-ত্রুটি মুক্ত করে বের করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। যদি নির্ভুল, চমত্কার বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া যায়, তাহলে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই মনের আনন্দে পড়াশোনা করবে। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে অনেক বেশি আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষকদের উচিত, বিষয়বস্তুকে সহজ করে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করা, যাতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আনন্দ পায়।

শিক্ষার্থীদের কাছে যদি পাঠ্যবই লোভনীয় করে তোলা যায়, তাহলে ওরা নোটবই প্রত্যাহার করার সাহস পাবে এবং কোচিংমুখী হয়ে পড়াশোনাটাকে দুর্বিষহ করে তুলবে না। শিক্ষার্থীরা যদি ভয়-ভীতিমুক্ত নির্মল পরিবেশে আনন্দের মাঝে পড়াশোনা করার পরিবেশ খুঁজে পায়, তাহলে অভিভাবকরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। তাই জাতির ভবিষ্যত্ আজকের শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিতে হবে। আর এ সুযোগ করে দিতে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।।

লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আজিমপুর গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ। প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031430721282959