মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তরপত্রে ভজঘট

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য |

২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে ঢাকার এক নামি স্কুলের শিক্ষিকা সংশ্লিষ্ট এক শিক্ষার্থীকে ৫১ নম্বর দিয়েছিলেন। ওই শিক্ষার্থী ইংরেজি প্রথমপত্রে ৮১ পেয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রে ৫১ নম্বর পাওয়ায় ওই শিক্ষার্থী ফলাফল চ্যালেঞ্জ করেন। পরে উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষায় দেখা যায়, নামি স্কুলের ওই শিক্ষিকা ইংরেজি দ্বিতীয়পত্রের উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেই শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে ৫১ নম্বর দিয়েছিলেন। ঘটনাটি ধরা পড়ায় ওই শিক্ষিকাকে ২০১৬ সালের এসএসসির উত্তরপত্র মূল্যায়ন থেকে বাদ দেয়া হয়।

এই ঘটনা শুধু ২০১৫ সালেই নয়, গত কয়েক বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে এ রকম ভজঘট অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারের মৌখিক নির্দেশনা অনুসারে পাসের হার বাড়াতে গিয়ে শুধু নামকাওয়াস্তে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন শিক্ষকরা। এতে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মান নিম্নমুখী হতে থাকে। আর ফলাফলকে চ্যালেঞ্জের সংখ্যাও

বাড়তে থাকে। ঢালাও মূল্যায়নে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করলেও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আটকে যাচ্ছে। যার ফলে চারদিকে ছিঃ ছিঃ রব ওঠে। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকে, আদালতের নির্দেশে শিক্ষার্থীর সামনে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষায় বসতে হচ্ছে।

এ অবস্থা বেরিয়ে আসার জন্য ২০১৬ সাল থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নে কড়াকড়ি আরোপ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে পাসের হার কমে যায়। কিন্তু মূল্যায়ন এখনো সঠিকভাবে আসেনি। এ অবস্থায় পাবলিক পরীক্ষায় যারা উত্তরপত্রের ওজন দেখে নম্বর দেন সেসব শিক্ষকদের শায়েস্তা করতে আইন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, দেশের গুটিকয়েক অসৎ শিক্ষক উত্তরপত্রের ওজন দেখে নম্বর দিচ্ছেন। যার প্রমাণ মিলছে পুনঃনিরীক্ষার ফলাফলে। প্রথম ধাপে ওই শিক্ষকরা উত্তপত্র ঠিকমতো দেখেননি, তাই পুনঃনিরীক্ষায় ফল পরিবর্তন হয়েছে।

আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেছেন, উত্তরপত্র ঠিকঠাকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারা শিক্ষকদের তালিকা হচ্ছে। এই তালিকায় যেসব শিক্ষকের নাম পাওয়া যাবে তাদের ভবিষ্যতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন থেকে বাদ দেয়া হবে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া বেশি টাকা পাওয়ার লোভে যেসব শিক্ষক তদবির করে বেশি উত্তরপত্র নেন তাদেরও তালিকা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক বলেছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে বোর্ডগুলো এখন যতটা আন্তরিক তা যদি ৭ বছর আগে থেকে হতেন তাহলে আজ শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীর ক্ষতি হতো না। এ অবস্থার জন্য শিক্ষাবোর্ডই দায়ী বলে শিক্ষকরা জানান। তারা বলেন, গত কয়েকবছর ধরেই উত্তরপত্র দেয়ার সময় বোর্ড থেকে মূল্যায়নকারী শিক্ষকদের বলা হতো, কোনো শিক্ষার্থী যেন ফেল না করে। যদি ফেল করে তাহলে মূল্যায়নকারী শিক্ষকের এমপিওসহ বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা কেটে নেয়া হবে। এ অবস্থায় শিক্ষকরা ঠিকঠাকভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করেই নম্বর দিয়ে দিতেন। এতে ভুলের সংখ্যা বেশি থাকত। ফলাফল চ্যালেঞ্জ হতো। এ বিষয়টি নিয়ে এখন সবাই কথা বলায় সরকার তার কৌশল পাল্টে ফেলে। দোষ চাপানো হয় শিক্ষকদের ওপর। সবকিছুর জন্য বোর্ডই দায়ী বলে শিক্ষকরা দৃঢ়ভাবে মত দেন।

কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ শিক্ষকদের এসব বক্তব্য মানতে নারাজ। তিনি বলেন উত্তরপত্রে ঢালাও নম্বর দেয়ার জন্য কোনো সময়ই শিক্ষকদের বলা হয়নি। কিছুসংখ্যক অসৎ শিক্ষক এ কাজ করেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রতিবছর পুনঃনিরীক্ষায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু কেন হচ্ছে? নিশ্চয়ই শিক্ষকদের অবহেলা রয়েছে। কিছু শিক্ষক সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না করে উত্তরপত্রের ওজন দেখে নম্বর দিয়ে দিচ্ছেন। আমরা এসব শিক্ষককে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। যারা নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকবেন না তাদের বেতন বন্ধ করা হবে, চাকরিচ্যুত ও শাস্তি ভোগ করতে হবে।

অশিক্ষকের হাতে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন : রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. আবুল কালাম এইচএসসি ও সমমানের একশ উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য দিয়েছিলেন শাহ্ মখদুম কলেজের প্রভাষক ও একটি কোচিং সেন্টারের রাবি শাখার পরিচালক মাসুদুল হাসানকে। সেই উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়নের জন্য মাসুদ দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই কোচিং সেন্টারে কর্মরত রাবির এক ছাত্রকে। ওই ছাত্র আবার উত্তরপত্রগুলো দেন তার এক বান্ধবীকে। বান্ধবীর শত্রুপক্ষ বিষয়টি প্রশাসনকে ধরিয়ে দেন। এরপরে বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের পাবলিক পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র সংশ্লিষ্ট পরীক্ষকরা না দেখে অন্যদের দিয়ে হরহামেশাই দেখাচ্ছেন। ইদানীং প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার খাতাও অন্যদের দিয়ে দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। শিক্ষকরা নিজেদের বদলে শিক্ষার্থী বা অশিক্ষকদের দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করালে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুরো শিক্ষাজীবনে। এ ছাড়া এসবের কারণে পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণের শত শত শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, লাখ লাখ উত্তপরত্র পরীক্ষকদের কাছে দেয়া হয়। তারা যদি সেই উত্তরপত্র না দেখে অন্যকে দিয়ে দেখান, সেটা শনাক্ত করা কঠিন। তবে কেউ বোর্ডে লিখিত অভিযোগ করলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেই।

পরীক্ষার্থী-অভিভাবকের সামনেই আবার দেখা হলো এসএসসির উত্তরপত্র : হাইকোর্টের আদেশে ভিকারুননিসার তিন ছাত্রীর এসএসসি পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের উত্তরপত্র আবার দেখা হলো। প্রচলিত বিধান অনুযায়ী পাবলিক পরীক্ষার খাতা পুনঃনিরীক্ষা হয়। অর্থাৎ প্রথমবার পরীক্ষক কর্তৃক খাতায় দেয়া প্রশ্নভিত্তিক নম্বরগুলো ফের গুনে দেখা হয়। আপত্তি দেয়া খাতা তৃতীয় পরীক্ষক দ্বারা ফের মূল্যায়ন করা হয় না। কিন্তু আদালতের আদেশে ভিকারুনিসার এই তিন ছাত্রীর খাতা তৃতীয় পরীক্ষক দ্বারা পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয় ঢাকা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ।

আদালতের আদেশ অনুযায়ী গত শনিবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কক্ষে উপস্থিত ছিলেন ভিকারুননিসার ইংরেজি ভার্সনের সহকারী প্রধান শিক্ষক নাজমুস নাহার। তিন ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের সামনেই তৃতীয় পরীক্ষক দ্বারা খাতা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। ওই তিন পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর যথাক্রমে ১০২২৬৬, ১০২১৫২, ১০১৭২৯। তবে, ফলাফল যা ছিল তা-ই রয়েছে। মানে তারা কথিত গোল্ডেন জিপিএ-৫ চেয়েছিল কিন্তু তা হয়নি। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের ওই তিন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলে তাদের বাংলা বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বরে অসন্তুষ্ট হয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। শুনানি শেষে গত ২৯ মে খাতা পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দেন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসাইন ও বিচাপতি মো. আতাউর রহমান খান।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028340816497803