যে আট কারণে শেখ হাসিনাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া উচিত

মুকিব মিয়া |

যে কোন পুরস্কার দেয়া হয় কৃতকর্মের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ। স্কুলে যখন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো তখন দেখতাম, যে প্রথম হতো তাকে দেয়া হতো প্রথম পুরস্কার। আর সে পুরস্কার তুলে দিতেন ক্রীড়া অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। প্রধান অতিথি করা হতো এলাকার একজন সুনামধন্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানিত শিক্ষক, কখনও বা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। আমার প্রশ্ন হলো শেখ হাসিনাকে কে পুরস্কার দেবে? মানবতার পুরস্কারটি তো অন্তরাত্মা অনেক আগেই শেখ হাসিনাকে দিয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো কে পুরস্কারটি তাঁর হাতে তুলে দিবেন? সভ্যতা তো আগেই তাকে (শেখ হাসিনা) পুরস্কৃৃত করার জন্য সদা প্রস্তুত। তৃতীয় প্রশ্ন হলো কেন তাঁকে পুরস্কৃৃত করা হবে?

শেখ হাসিনাকে কেন নোবেল শান্তি পুরস্কার দিবেন?

১. পাবর্ত্য অঞ্চলের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত অনেক ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস। বিভিন্ন সময়ে উপজাতি এবং পাহাড়ী বাঙালিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। অনেক ঘরবাড়ি, বসতভিটে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কারফিউ জারি করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, আমদানি রপ্তানি, চোরাচালন, মানব পাচার ইত্যাদি নানা অপকর্মের জায়গা ছিল পার্বত্য অঞ্চল। এক কথায় সভ্যতার আলো থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। যাকে বলা যায় ‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’। অবশেষে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা হলেন সরকার প্রধান। তখন থেকেই শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে পাহাড়ি অঞ্চলে। ১৯৯৭ সালে পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র উপজাতি এবং বাঙালিদের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ‘শান্তি চুক্তি’। যে চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারি সমস্ত মানুষের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত হয়েছে। পাহাড়ি বাঙালি ভাই ভাই, আমাদের মধ্যে কোন বিভেদ নাই। আমরা সবাই এক এবং অভিন্ন, মানবতাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। জয় হোক মানুষের। এই স্লোগানটি প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। সেজন্য তাঁকে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’ দেয়ার দাবি করছি।

২. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সহপরিবারে যখন ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো, সেই দিন থেকে গণতন্ত্র বিদায় নিয়ে ছিলো। সামরিক শাসন, কালো আইন, একনায়ক কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ভন্ডামী, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। অবশেষে ১৯৮১ সালে মানবতার কল্যাণে, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ফিরিয়ে আনতে তিনি দেশে ফিরলেন। আত্মনিয়োগ করলেন মানব কল্যাণে। হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। সেজন্য তাকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। উনিশ বার ভয়াল ২১শে আগস্টের মতো গ্রেনেড হামলার সম্মুখিন হতে হয়েছে। দেশের মানুষের প্রতি আস্থা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, মেধা-প্রজ্ঞা, মমত্ববোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদির স্বাক্ষর দেখিয়েছেন তিনি। আজ বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা, স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দিলে পুরস্কারটির মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি।

৩. নারী অধিকার: দীর্ঘদিন এই উপমহাদেশের নারীরা ছিল অবহেলিত। মৌলিক অধিকার তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রে সাংসারিক স্বীকৃতি পর্যন্ত পায়নি। অত্যাচার, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি ছিল নিত্য নতুন বিষয়। উপেক্ষিত ছিল নারী শ্রম। স্বামীগৃহে ছিল তারা লাঞ্ছিত। সামাজিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা ছিল পিছিয়ে। অপুষ্টি, কুসংস্কার, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, নিরক্ষতা, তাদের জীবনকে করে তুলেছিল দুর্বিষহ। নারীর এই করুণ চিত্রটি শেখ হাসিনাই প্রথম উপলদ্ধি করেন। কারণ তিনি ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন তাঁর মাতা শেখ ফজিলাতুনেছা মুজিব কিভাবে পিতা বঙ্গবন্ধুকে সাহস এবং প্রেরণা জোগাতেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন একমাত্র তিনিই পর্দার অন্তরালে থেকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিতেন। তাই শত বাধা-বিপত্তি, মৌলবাদীদের হুমকি উপেক্ষা করে নারীদের অধিকার সনদ জ্ঞাপক ঐতিহাসিক ‘নারী নীতি’ গ্রহণ করলেন। সে জন্য নারীরা পেল সাংবিধানিক স্বীকৃতি। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে নারী তার অধিকার ফিরে পেল। বাল্যবিবাহ, পণ-প্রথা, ইভটিজিং ইত্যাদির বিরুদ্ধে গ্রহণ করলেন ‘জিরো টলারেন্স নীতি’। এই সমাজের পিছিয়ে পড়া অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ‘নোবেল শান্তি’ পুরস্কার দেয়া হোক।

(৪) একটা সময় মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ছিল নিত্যদিনের সংবাদ। বর্তমানে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। আর তা সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ, মেডিকেল কলেজ স্থাপন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে। এ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন জাতিসংঘ কর্তৃক ‘সাউথ সাউথ’ পুরস্কার। এসব অর্জনও দাবি রাখে তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার।

(৫) জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণেই বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেন, ‘‘Bangladesh is the emerging Tiger of South-east Asia.” যে দেশকে এক সময় Bottomless Basket বলা হতো, সে দেশটি এখন মধ্যম আয়ের দেশে উপনীত হয়েছে। তাই উন্নয়নের মডেল হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের জোর দাবি রাখছি।

(৬) সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের মত নানা ত্রাসে বিশ্ব এখন প্রকম্পিত। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। এমনি এক সময়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে “Zero Tolarence” নীতি। লেখক, বৃদ্ধ, ছাত্র-শিক্ষক কেউ রক্ষা পাচ্ছেনা জঙ্গিবাদের হুমকি থেকে। এমনকি অনেক নিরাপরাধ মানুষকে পর্যন্ত খুন করতে দ্বিধা করছে না জঙ্গিরা। তিনি যে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে সদা প্রস্তুত, তা তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।

তাঁর সময়োচিত সাহসী পদক্ষেপে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট থেকে ২০ জন লোককে জঙ্গিদের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা পর্যন্ত শাহাদাৎ বরণ করেন।

৭. ছিটমহল সমস্যার নিরসন: ছিটমহল সমস্যা ছিল সীমান্ত তীরবর্তী দেশ ভারত এবং বাংলাদেশের জন্য বোঝা স্বরূপ। এটি ছিল মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ। ছিটমহলের বাসিন্দারা নয় ভারত, নয় বাংলাদেশ। কোন দেশেরই নাগরিক ছিল না তারা। ফলে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া তাদের লাগেনি। ছিটমহলের অধিবাসীদের সমস্যা নিরসনে আরেকটি স্বাধীন দেশ ভারতের সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করতে হয়েছে। অবশেষে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ঐতিহাসিক ‘ছিটমহল বিনিময়’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক হবার অধিকার পায় ছিটের বাসিন্দারা। তাই ছিটের অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া, নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল শান্তি পদকটি তাঁকে দেয়া হোক।

৮. রোহিঙ্গা সমস্যা: বাংলাদেশ পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের পক্ষে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ তা সমর্থন করে না। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং সহাবস্থান। প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়ে ফেলা হচ্ছে। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তাদের। নাফ নদী এখন রক্তগঙ্গা ¯্রােতধারায় পরিণত হয়েছে। ঠিক ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল বাংলাদেশে সেই একই চিত্র ফুটে উঠেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে।

এবিষয়টি মানবতার নেত্রী শেখ হাসিনার মনকে নাড়া দেয়। কারণ তিনি জানেন স্বজন হারানোর বেদনা কি। তাই তিনি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মানবাধিকার সংগঠনসহ পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষকে ওদের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানান। ১৬ কোটি জনসংখ্যার একটি ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও অতিরিক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে ঘৃনা প্রকাশ করেন সন্ত্রাসবাদের প্রতি। তাঁর ভাষায়, ‘১৬ কোটি মানুষের খাবার দেই, সেই সঙ্গে কয়েক লাখ মানুষকে খাবার দেবার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। আমরাও তো রিফিউজি ছিলাম। রিফিউজি থাকার যন্ত্রণা কী তা আমরা বুঝি।’ তাই তিনি এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর উদাত্ত আহবান জানান। সেজন্য তাকে ‘নোবেল শান্তি পদক’ দেয়া হোক।

আমার দাবিটি কোন রাজনৈতিক দাবি নয়। এটি অধিকারের স্বীকৃতি। কাজের স্বীকৃতি তাঁকে শেখ হাসিনা) দেয়া হোক। নাফ নদীর পানিতে ভেসে থাকা ছোট মেয়েটির কথা ভেবে শান্তি পদকটি শেখ হাসিনাকে দেয়া হোক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান স্বরূপ তাঁকে পদকটি দেয়া হোক। মানবতার কল্যাণের আলোকবর্তিকা হিসাবে শেখ হাসিনাকে নোবেল শান্তি পদকটি দেয়া হোক। রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী ৮ লাখ রোহিঙ্গাদের রক্তের শপথ স্বরূপ নোবেল শান্তি পদকটি তাঁকে দেয়া হোক।

লেখক: মুকিব মিয়া, শিক্ষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028069019317627