রজতজয়ন্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

ড. হারুন-অর-রশিদ |

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যে শুধু আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেই বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় তা নয়, বিশ্বের মধ্যেও অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় এটি। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জাতীয় সংসদের এক আইন বলে এর জন্ম। ২১ অক্টোবর এর প্রতিষ্ঠা দিবস। এ বছর ২১ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর বা রজতজয়ন্তী। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি।

স্বাধীনতার পরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে কমিশন স্বাধীন দেশের প্রয়োজন উপযোগী বিজ্ঞানভিত্তিক একটি রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী একদল ঘাতক-খুনি চক্রের হাতে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের কারণে ওই রিপোর্ট আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সে সময়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কলেজগুলো যুক্ত থাকায় সেসবের একাডেমিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও নিবিড় মনিটরিং সম্ভব হচ্ছিল না। অন্যদিকে, ওই তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পড়েছিল অতিরিক্ত একাডেমিক ও প্রশাসনিক চাপ। এ উভয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে কমিশনের রিপোর্টে কলেজগুলোকে সেখান থেকে সরিয়ে এনে দেশের চারটি অঞ্চলে চারটি এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার সঙ্গে সেগুলোকে যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। তাই বলা যায়, কুদরত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্টের আলোকে ১৯৯২ সালে উল্লিখিত তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পূর্বে যুক্ত ৬৪০টি কলেজকে অন্তর্ভুক্ত করে অধিভুক্তিদানের ক্ষমতাসহ বর্তমান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়।

বিগত ২৫ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ২২৪৯টি স্নাতক, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর কলেজ ও বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে অধিভুক্ত রয়েছে (সরকারি ২৭৫, বেসরকারি ১৬২০, বিশেষায়িত ৩৫৪)। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ লাখের ওপর (সরকারি প্রায় ১২ লাখ এবং বেসরকারি ৮ লক্ষাধিক)। শিক্ষক সংখ্যা ৬০ হাজারের মতো। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৮ ধরনের ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বছরে ১২৮ ধরনের পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত দেশের প্রায় ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী এ প্রতিষ্ঠানের কলেজগুলোতে পড়াশোনা করে থাকে। বছরে স্নাতক (পাস) ও স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ৭ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে থাকে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বাংলাদেশজুড়ে।

প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি গাজীপুর ক্যাম্পাস থেকে গতানুগতিক পদ্ধতিতে বিশেষ করে ডাক বিভাগের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়ে আসছিল। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পর শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ায় ক্লাস শুরু করতেই ৯ মাসের মতো বিলম্ব হতো। অপরদিকে, ৭-৮ মাসেও পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। ফলে শিক্ষার্থীদের জীবনে সৃষ্টি হয় এক দুর্বিষহ সেশনজট, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন বছরের সীমা অতিক্রম করে। ফলে তা কেড়ে নেয় শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্যবান সময়। এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাদের দরিদ্র অভিভাবক ও বৃহত্তর সমাজের ওপর। শিক্ষার অধিকতর মানোন্নয়নের বিষয়টি থাকে উপেক্ষিত। শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষার প্রবেশপত্র, কলেজ মাইগ্রেশন, শিক্ষকদের উত্তরপত্র গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও অন্যান্য কাজের সম্মানীর বিল জমা এবং চেক গ্রহণ ইত্যাদি সব কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের দূরদূরান্ত থেকে গাজীপুর ক্যাম্পাসে আসতে হতো। পরীক্ষা কমিটি গঠন, উত্তরপত্র বণ্টন ইত্যাদি ব্যাপারে ছিল না কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। প্রতিবছর অন্তত একবার যেখানে সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল, সেখানে ২০০৭ সালের পর ২০১৩ সালের ৬ মার্চ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে আমার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত মাত্র একবার (২০১২ সাল) সিনেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়নি। এ পর্যন্ত কখনও উদযাপিত হয়নি এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

সেশনজট নিরসন এবং অধিকতর গুণ ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা- এ দুটো বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে সাড়ে চার বছর পূর্বে ২০১৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পথচলা শুরু। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশজুড়ে বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান গাজীপুর ক্যাম্পাস থেকে গতানুগতিক পদ্ধতিতে পরিচালন যে কিছুতেই সম্ভব নয়, সেটি শুরুতেই আমরা উপলব্ধি করি। এটিকে গতিশীল করতে আবশ্যক ছিল ব্যবস্থাপনার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সম্পূর্ণ আইটিভিত্তিক এর পরিচালন। সেশনজট নিরসন, শিক্ষার উন্নয়ন এবং প্রশাসনকে গতিশীল করতে বর্তমান প্রশাসন প্রয়োজনীয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থেই একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এর অধিকাংশ শিক্ষার্থী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ও অসচ্ছল পরিবারভুক্ত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে এ দেশের লাখ লাখ পরিবারের ভাগ্যের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ। দেশের সার্বিক উন্নয়নেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পালন করতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দেশে উচ্চশিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার ঘটেছে। এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা।

কোনো সভ্যতা যেমন একদিনে গড়ে ওঠে না, তদ্রূপ কোনো প্রতিষ্ঠানও একদিনে গড়ে ওঠে না। এ জন্য আবশ্যক হয় বহু জনের বহু সময়, শ্রম ও সাধনার। সবার অবদানই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন এবং এর পরিচালনে নেতৃত্বদান করেছেন তাদের প্রত্যেকের অবদান আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। তবে এখনও আমাদের পথচলার অনেক বাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আমি এর সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, অভিভাবক, গভর্নিং বডির সদস্য ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই।

ড. হারুন-অর-রশিদ : উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003558874130249