শিক্ষক সঙ্কটে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত

বিভাষ বাড়ৈ |

শিক্ষক সঙ্কটে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে সারাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। অথচ ৩৪তম বিসিএসের মাধ্যমে নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ৪৫০ জন সহকারী শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়াও ঝুলে আছে প্রায় এক বছর ধরে। পিএসসির সুপারিশের পর ১১ মাসেরও বেশি সময় চলে গেলেও পুলিশ ভেরিফিকেশন ও মেডিক্যাল রিপোর্ট তৈরিতে বিলম্বের কারণে চাকরিতে যোগদান করতে পারছেন না সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের এ ৪৫০ সহকারী শিক্ষক। একদিকে দুই হাজার পদ শূন্য অন্যদিকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদেরও কাজে যোগদানে বিলম্বের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এদিকে পদ সৃষ্টি ছাড়াই একাদশ শ্রেণি চালু করায় সঙ্কটের মুখে পড়েছে অনেক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

শিক্ষক সঙ্কট ও নিয়োগে বিলম্বের কারণে শিক্ষা ব্যাহত হওয়ায় উদ্বিগ্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। কর্মকর্তারা অন্তত বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়াদের দ্রুত পুলিশ ভেরিফিকেশন ও মেডিক্যাল রিপোর্ট তৈরির কাজের খোঁজখবর নিচ্ছেন নিয়মিত। স্কুলের প্রধান শিক্ষকরাও প্রতিদিন মাউশিতে এসে নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সঙ্কটের কথা জানিয়ে নতুন শিক্ষক চাচ্ছেন। মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান বলছিলেন, এমনিতেই শিক্ষক সঙ্কট আছে, তারও ওপর নিয়োগের কাজটাও অনেক দিন ঝুলে আছে। অনেক দিন হয়ে গেল তবু পুলিশ ভেরিফিকেশন ও মেডিক্যাল রিপোর্টের কাজ শেষ হয়নি। দ্রুত কাজ শেষ হওয়া দরকার। কারণ এই শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে পারলেও শিক্ষক সঙ্কটের কিছু সমাধান হবে। তবে যতদূর জানি নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে পুরো কাজ না হলে তাদের পদায়ন করতে পারছি না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি স্কুলে শিক্ষক সঙ্কট বেড়েই চলেছে। শিক্ষক স্বল্পতার কারণে রাজধানীর সরকারি হাই স্কুলগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা শিক্ষকদেরও বদলি করতে পারছে না মাউশি। আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো। এ শিক্ষকদের চাকরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার পর ২০১২ সালে নিয়োগ কার্যক্রম পিএসসির অধীনে চলে যায়। এ শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য পৃথক কোন পরীক্ষা না নিয়ে বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যারা ক্যাডার পদ পাননি এমন প্রার্থীদের মধ্য থেকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

সারাদেশের ৩৩৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট সহকারী শিক্ষকের পদ রয়েছে দশ হাজার ২৬৮টি। এর মধ্যে দুই হাজারের বেশি পদ এখন শূন্য। গত বছরের আগস্টে ৪৫০ জন প্রার্থীর বিষয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়ে তা এখনও চলমান রয়েছে। যদিও কথা বলে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই ভেরিফিকেশন রিপোর্ট চূড়ান্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এদিকে ৩৫তম বিসিএসের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের জন্য আরও এক হাজার ৫১৮ জনের একটি প্রস্তাব মাউশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার পর পিএসসিতে পাঠানো হয়।

শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সারাদেশের দুই শতাধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে বলছেন মাউশির কর্মকর্তারা। এর মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে প্রায় দেড় শতাধিক স্কুল চলছে মাত্র ৩/৪ জন শিক্ষক দিয়ে। ৮২টি ডাবল শিফটের স্কুলে প্রভাতী শাখায় অফিস সহকারী ও এমএলএসএস নেই। এসব স্কুলেও প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। ৮৫টি হাই স্কুল চলছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া। কর্মচারীর পদও শূন্য রয়েছে প্রায় দুই হাজার। উপজেলা পর্যায়ের বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই ইংরেজী, গণিত, হিসাব বিজ্ঞানসহ জটিল বিষয়ের কোন শিক্ষক নেই। জোড়াতালি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে দুই শতাধিক সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

এছাড়াও বিদ্যালয় পরিদর্শক, সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মোট ৯৪৯টি পদের অর্ধেকের বেশি পদই ফাঁকা রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারী হাই স্কুলে একাডেমিক তদারকি ও নজরদারি প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম।

সর্বশেষ ২০১০ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২০১২ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট এক হাজার ৯০৩ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর সরকার ২০১২ সালের ১৫ মে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ‘সেকেন্ড ক্লাস গেজেটেড’ মর্যাদা প্রদান করে, আগে তা ‘থার্ড ক্লাস গেজেটেড’ মর্যাদা পেতেন। সেকেন্ড ক্লাস গেজেটেড’ মর্যাদা প্রদানের পর শিক্ষকদের নিয়োগ এখতিয়ার পিএসসির অধীনে চলে যায়। এর ফলে নতুন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন হয়। পিএসসিতে নিয়োগের জন্য আবেদন করলে সংস্থাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়, নতুন বিধিমালা না হলে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে না।

পরে পিএসসির নিয়ম অনুযায়ী ২০১৩ সালের প্রথমদিকে খসড়া নিয়োগ বিধিমালা তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় মাউশি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও তা অনুমোদন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠালে অনেক বিলম্বে তা অনুমোদন হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেখানেও আটকে থাকে দীর্ঘদিন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লাগাতার তদবিরে এক পর্যায়ে তা অনুমোদন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু সচিব কমিটির সভায় সেটা আর উত্থাপন হচ্ছে না বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই অবস্থায় বিসিএসের সর্বশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, কিন্তু ক্যাডার পদে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি-এমন প্রার্থীদের মধ্য থেকে সরকারি হাই স্কুলে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ আসে পিএসসির পক্ষ থেকে।

তবে সঙ্কটের এখানেই শেষ নয়। জানা গেছে, পদ সৃষ্টি ছাড়াই একাদশ শ্রেণি বা কলেজ চালু করায় সঙ্কটের মুখে পড়েছে অনেক সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। একাদশ শ্রেণি চালু করার ৯ বছর চলে গেলেও আজ পর্যন্ত এসব বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির জন্য শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। মাউশি সঙ্কট নিরসনে দফায় দফায় পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করলেও ফলাফল শূন্য। ফলে ইতোমধ্যেই তিনটি বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠান জোড়াতালি দিয়ে অর্থাৎ স্কুল শিক্ষক ও খ-কালীন বেসরকারী কলেজ শিক্ষক দিয়েই চালাচ্ছে সরকারী কলেজ!

মাউশি মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, পদ সৃষ্টির জন্য যে প্রস্তাব আমরা করেছিলাম তা সেভাবেই পড়ে আছে, পদ সৃষ্টি হয়নি। কয়েকজন শিক্ষককে সংযুক্ত হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিল এসব প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তারাও সেখান থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। এখন সমস্যা আরও বেড়েছে। স্কুল শাখায় যোগ্যতম শিক্ষকদের দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে বড় ও মানসম্পন্ন সরকারি বিদ্যালয়েই চালু করা হয়েছিল একাদশ শ্রেণি। ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ ও ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে দেশের সবচেয়ে বড় ১১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।

প্রথমে স্কুলগুলোতে দু’তিন জন করে সরকারি কলেজের প্রভাষক পদায়ন বা পদায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তীতে আর শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি। স্কুলগুলোতে দু’একজন কলেজ শিক্ষক পদায়ন হলেও তারা স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে চাকরি করতে স্বস্তিবোধ করছেন না। আবার স্কুল শিক্ষকরাও কলেজ শিক্ষকদের মেনে নিতে পারছেন না। কলেজ শাখার জন্য পৃথক শিক্ষক না থাকায় প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের।

প্রাইভেট টিউশনির লোভে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা সম্মানী ভাতা ছাড়াই সরকারি স্কুলের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। এ বিষয়ে মতিঝিলের একটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, আমাদের স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে দুই শিফটে ১৫০ জন করে ৩০০ জন ছাত্র আছে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোন শিক্ষক নেই। স্কুল শাখার শিক্ষক দিয়েই ছাত্রদের পাঠদান করা হচ্ছে। বারবার দাবি জানালেও কলেজ শাখার জন্য পদ সৃষ্টি হচ্ছে না।

ঢাকার অপর একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলছিলেন, শিক্ষক স্বল্পতা নিয়ে খুব কষ্টে আছি। স্কুল শিক্ষক দিয়ে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে হচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পদ সৃষ্টি না করেই হঠাৎ এই স্কুলে একাদশ শ্রেণি চালু করা হয়। প্রথমে তিনজন প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে আর পদ সৃষ্টি করা হয়নি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023980140686035