রংপুরে অবস্থিত শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদের নাম ভাঙিয়ে তার শ্যালক শামীম হাসানের টেন্ডারবাজি বিভিন্ন কাজ ভাগ-বাটোয়ারাসহ ক্ষমতার দাপট নিয়ে অসহায় কর্মকর্তা-কর্মচারী আর ঠিকাদাররা, টেন্ডার আহ্বান করলেই মন্ত্রীর শ্যালকের নিজ নামীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মীম এন্টারপ্রাইজকে কাজ দিতেই হবে। গত ৪ বছরে রংপুর জোন অফিস থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার বাগিয়ে নিয়েছেন মন্ত্রীর শ্যালক শামীম। আর মন্ত্রীর শ্যালককে সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আহ্বান করা টেন্ডারে অংশ নেয়া অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র অসম্পূর্ণ আর ভুল দেখিয়ে তার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী দেলায়ার হোসেন মজুমদার শিক্ষামন্ত্রীর শ্যালকের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী ও শিক্ষামন্ত্রীর শ্যালকের টেন্ডারবাজি নিয়ে ধারাবাহিক দুই পর্বের প্রতিবেদনের আজ শেষ পর্ব।
সার্বিক বিষয়ে তথ্য অধিকার আইনে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর রংপুরেরর নির্বাহী প্রকৌশলীর দফতরে আবেদন করে তথ্য না পেয়ে অবশেষে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করার দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস পর পাওয়া তথ্য অনুসন্ধান করে জানা গেছে নানান অনিয়মের চিত্র। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এই দফতরে ঠিকাদারি লাইসেন্স পেতে হলে ঠিকাদারি কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা আর্থিক স্বচ্ছতাসহ অনেক কাগজ আবেদনের সঙ্গে দাখিল করতে হয়। তবে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কোন কর্মকর্তা কর্মচারীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলে তাকে লাইসেন্স প্রদান করা হয় না। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি লাইসেন্স পাওয়ার আবেদনকারীকে প্রত্যয়নপত্র বা এফিডেভিট প্রদান করতে হয়। সেখানে উল্লেখ করতে হয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কোন কর্মকর্তা কর্মচারীর সঙ্গে তার কোন আত্মীয়তা নেই। এক্ষেত্রে এ বিভাগের মন্ত্রীর শ্যালক হলেও এ বিষয়টি গোপন করা হয়েছে।
শুধু তাই নয় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর শ্যালক শামীম হাসানের প্রতিষ্ঠান মেসার্স মীম এন্টারপ্রাইজকে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রদান করা হয়। যা সম্পূর্ণ বেআইনি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট দফতরের একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করলেও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুধু তাই নয় গত ৪ বছরে রংপুর জোন থেকে বিভিন্ন ধরনের ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ হাতিয়ে নিলেও প্রায় সব কাজই তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে মন্ত্রীর শ্যালকের প্রতিষ্ঠানের নামে পাওয়া কাজগুলো তার পছন্দের ঠিকাদার। বিনিময়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মন্ত্রীর শ্যালক।
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে তথ্য না পেয়ে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করার পর দীর্ঘ ৬ মাস পর পাওয়া তথ্য কমিশনে অভিযোগ করার পর শিক্ষামন্ত্রীর শ্যালকের ৪ বছরের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে করা কাজের বিবরণ অনুসন্ধান করে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গেছে ২০১৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর শ্যালক শামীম ৫টি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন। এগুলো হলো পার্বতীপুর দারুস সুন্নাহ দাখিল মাদ্রাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ৬৩ লাখ টাকা, এ কাজটি কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ২২ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে। একই বছরের ২৭ মার্চ খলেয়া খাপরিখাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন যার টেন্ডার মূল্য ৬৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই বছরের ২ অক্টোবর কার্যাদেশ পেয়েছেন কান্দি আর আই ফাজিল মাদ্রাসার আসবাবপত্র সরবরাহ কাজ যার টেন্ডার মূূল্য ৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, একই বছর ২০১৪ সালের মধ্যধনগড়া দাখিল মাদ্রাসার আসবাবপত্র সরবরাহ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া ২০১৪ সালে আরও একটি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন মন্ত্রীর শ্যালক শামীম যার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ১৪ মে ২০১৪ তারিখে কাজটি হলো রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের তারামন বিবি হোস্টেল ভবনের মেরামত ও সংস্কার কাজ যার টেন্ডার মূল্য ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
২০১৫ সালে মন্ত্রীর শ্যালক শামীম রংপুর জোন থেকে ৭টি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন। এগুলো হলো কুর্শাবলরাম জাকেরিয়া দাখিল মাদ্রাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ৭০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তাকে কার্যাদেশ দেয়া হয় ২৭.১২.২০১৫ তারিখে। একই বছরের ১৯ জানুয়ারি কার্যাদেশ দেয়া হয় পাগলাপীর উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের দ্বিতল ভবন নির্মাণ ও স্যানিটারি ও পানি সরবরাহ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ১ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই বছরের ৭ মে তারিখে কার্যাদেশ দেয়া হয় রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেইন গেটসহ সীমানা প্রাচীর ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ২০ লাখ ৬২ হাজার টাকা, একই বছরে রংপুর জিলা স্কুলের প্রশাসনিক-কাম একাডেমিক ভবন কাজ দেয়া হয়েছে যার টেন্ডার মূল্য ১৫ লাখ টাকা কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে একই তারিখে ৭ মে ২০১৫ তারিখে।
অনুসন্ধানে একই দিনে দুটি কাজ হাতিয়ে নেন মন্ত্রীর শ্যালক শামীম। এছাড়াও একই বছরে সরকারি কলেজের বিজ্ঞান ভবন মেরামত কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এ কাজটির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ২৫ মে ২০১৫ তারিখে। এছাড়া ৭ মে ২০১৫ তারিখে আরও দুটি কাজ হাতিয়ে নেন মন্ত্রীর শ্যালক শামীম কাজ দুটো হলো পীরগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র সরবরাহ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা এবং সুন্দরগঞ্জ আমেনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র সরবরাহ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। অনুসন্ধানে দেখা ২০১৫ সালের ৭ মে এক সঙ্গে ৪টি কাজের ঠিকাদারি হাতিয়ে নেন মন্ত্রীর শ্যালক। অন্যদিকে ২০১৬ সালে দুটি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে বুড়িরহাট সহ ৩টি বিদ্যালয়ে আসবাবপত্র সরবরাহ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ২৪ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, এই কাজটির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ১১ ফেরুয়ারি ২০১৬ তারিখে। অন্যদিকে একই বছরের ২০ জুন তারিখে নয়াপুকুর মসজিদা খাতুন মহিলা কলেজের ভবন ঊর্ধ্বমুখীকরণ কাজ যার টেন্ডার মূল্য ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কাজটির কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ২০ জুন ২০১৬ তারিখে। সর্বশেষ চলতি বছর মন্ত্রীর শ্যালক শামীম তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীম এন্ট্রারপ্রাইজের নামে পাগলাপীর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের বিদ্যমান ভবন ঊর্ধ্বমুখী ও সম্প্রসারণ কাজটিও হাতিয়ে নেন। যার টেন্ডার মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে। এভাবেই মন্ত্রীর শ্যালকের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর রংপুর জোন থেকে ৪ বছরে ১০ কোটি টাকার ১৪টি কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। মজার ব্যাপার তার পাওয়া কোন কাজই তাকে অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিতে হয়নি। তিনি টেন্ডার দাখিল করেছেন আর মন্ত্রীর শ্যালকের ক্ষমতার দাপটে বিভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ তাকে দেয়া হয়েছে।
রংপুর অফিসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও ঠিকাদার জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন তার অপকর্ম ঢাকতে এবং মন্ত্রীর শ্যালককে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে প্রকৃত ঠিকাদারদের বঞ্চিত করে অনেক কাজ প্রদান করেছেন। সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ঠিকাদার ও অফিসের কর্মকর্তা জানান মন্ত্রীর শ্যালক শামীম যখন অফিসে আসেন তাকে রাজকীয় সম্মান দিয়ে অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে রুদ্ধদার বৈঠক করেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নেয়া ছাড়াও বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে উপরি নিয়ে কাজ ভাগ-বটোয়োরা করে দেন। রংপুর জোন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম জোন অফিস থেকে বেনামে কোটি কোটি টাকার টেন্ডার হাতিয়ে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়া মহল্লার এক ঠিকাদারের কাছে তার পাওয়া সব কাজ বিক্রি করে দেন। বিনিময়ে গত ৪ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর রংপুর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে গতকাল দুপুরে শিক্ষামন্ত্রীর শ্যালক শামীম হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কোন কথা বলতে রাজি হননি। পরে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ জানতে চাইলে তিনি বলেন এসব ব্যাপারে কোন কথা তিনি বলবেন না। তবে তিনি ঠিকাদারি করেন টেন্ডার দেন কাজ পেলে করেন না হলে করেন না। মন্ত্রীর শ্যালক হিসেবে ঠিকাদারি লাইসেন্স পাওয়া বেআইনি কিনা তা নাকি তার জানা নেই বলে জানান।
সূত্র: দৈনিক সংবাদ, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭।