শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগে শিক্ষকের দক্ষতা

মো. আবুল বাশার |

একটি দেশের মানসম্পন্ন শিক্ষা যে সকল বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দৈনন্দিন শ্রেণি কার্যক্রম। পৃথিবীর যে সকল দেশ শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে তারা শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করে থাকেন। আমাদের দেশেও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগের প্রচেষ্টা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু সফলতা থাকলেও পুরোপুরি সফল এ কথা বলা যাচ্ছে না। সমালোচকরা বলেন, আমাদের ব্যর্থতার কথা। শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করলে বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি তবে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে।

আমরা সরেজমিন পরিদর্শন ও আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের অনুশীলনের সময় দেখতে পাই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যারা প্রশিক্ষণ প্রদান করেন তাঁরা বলেন, অনেক পবির্তন হয়েছে। ধীরে ধীরে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। বেশ কিছু অসুবিধার কথা তাদের কাছ থেকেও পাওয়া যায়। তবে সকলেই স্বীকার করেন যে, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে পাঠ পরিচালনা করতে পারলে শিক্ষার্থীদের শিখন মানসম্পন্ন হয়। সমালোচক, শিক্ষক, প্রশিক্ষক সকলের কথা থেকে সাধারণ যে সকল সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার কথা উঠে আসে তা হল- শ্রেণিতে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী, শ্রেণির আসন ব্যবস্থা অনুকূল নয়, পিরিয়ডের ব্যাপ্তি কম, , শ্রেণিকক্ষের আকার আকৃতিগত সমস্যা, শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও সরঞ্জামের ঘাটতি, শিখন-শেখানো কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব ইত্যাদি।

উল্লিখিত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি বাদে সবগুলিই প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। কেবল একটি অর্থাৎ শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব-এই সমস্যাটির সমাধানের জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। প্রয়োজনীয় দক্ষতাসমূহ অর্জন করতে পারলে উল্লিখিত বাকী সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব।

যেমন, যদি প্রয়োজনীয় দক্ষতা একজন শিক্ষকের থাকে তাহলে অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী সম্বলিত শ্রেণিতে ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। এজন্য প্রথমেই শিক্ষকদের জানা উচিত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক কোন কোন পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ উপযোগী। প্রয়োগ উপযোগী এসকল পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে শিক্ষকের কিছু সুনির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন করার প্রয়োজন হয়। এসকল দক্ষতার প্রধান ক্ষেত্রসমূহ হচ্ছে, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা, শিক্ষকের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা, যোগাযোগ দক্ষতা, আন্ত:ব্যক্তিক দক্ষতা, বিশ্লেষণমূলক চিন্তন দক্ষতা ,মনোবৈজ্ঞানিক দক্ষতা / আচরণ সম্পর্কিত দক্ষতা, শিক্ষার্থীদের পাঠে অংশগ্রহণ করানোর দক্ষতা, একীভূতকরণ দক্ষতা, প্রশ্নকরণের দক্ষতা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, বিষয়বস্তু সংশ্লিষ্ট উপকরণ চিহ্নিতকরণ, সংগ্রহ ও সময়োপযোগী ব্যবহার দক্ষতা, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার দক্ষতা ইত্যাদি।

ক্ষেত্রসমূহ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার এবং দক্ষতাসমূহ অর্জনে সহায়তার জন্য এই আলোচনা। প্রথমত, শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতার ক্ষেত্র অনেক বড়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষকের পেশাদারিত্বকে শিক্ষকের ভাবভঙ্গি, সময়ানুবর্তিতা,শৃঙ্খলাবোধ ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান এই ৪টি উপক্ষেত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। অর্থাৎ একজন শিক্ষকের শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে ইতিবাচক। সময়ানুবর্তিতার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত করতে হলে শিক্ষকের নিজেকেও শৃঙ্খলার চর্চা করতে হবে। তাছাড়া শৃঙ্খনা বজায় রাখতে না পারলে যথাযথভাবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। শিক্ষকতা পেশার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ভিত্তিতেই একজন শিক্ষক নির্ধারণ করতে সক্ষম হবেন তিনি কোন কোন পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করবেন এবং তা কখন , কীভাবে করবেন। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশলের মাধ্যমে শিখন-শেখানো কাজ পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

তারপর, প্রয়োজন শিক্ষকের প্রস্তুতি ও যথাযথ পরিকল্পনা করার দক্ষতা। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়ার দক্ষতা থাকতে হবে। এর আওতায় পড়ে পাঠ পরিকল্পনা ও ক্লাসের প্রস্তুতি। পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নের দক্ষতা একজন শিক্ষকের জন্য অপরিহার্য। শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, গতানুগতিক পাঠ পরিকল্পনা নয়, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করানোর উপযোগী পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন দক্ষতা থাকতে হবে। পাঠ পরিকল্পনায় কাজগুলি হবে শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য ও বয়স বিবেচনা করে। পাঠের যে কোন অংশের অপারগতার জন্য নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা থাকতে হবে। অংশগ্রহণমূলক কাজ করানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যপত্র, কর্মপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী প্রস্তুত করে রাখা, লিখিত ও মৌখিকভাবে শিখন যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শীট প্রস্তুত করে রাখতে পারা, কম সামর্থ্যবিশিষ্ট বা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রস্তুত করে রাখতে পারা ইত্যাদি।

শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে যোগাযোগ দক্ষতা। কেননা সঠিকভাবে যোগযোগ করতে না পারলে শিখনফল অর্জন সম্ভব হবে না। প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে হবে। স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলার দক্ষতা থাকতে হবে। দৃষ্টি বিন্যাস কার্যকর যোগাযোগের সহায়ক। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে না থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী পায়চারী করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তারপর নিজে বলতে হবে বা উত্তর দিতে হবে। পাঠে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করানোর জন্য শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব বুঝে সে অনুযায়ী পদ্ধতি, কৌশল ব্যবহার করলে এবং শিক্ষার্থীদের সাথে যথাযথ আচরণ করলে শিখন-শেখানো কার্যকর, ফলপ্রসূ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সহজ হবে।

মনোবৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রের আওতায় সাধারণত আসতে পারে-শিক্ষার্থীদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতা, অংশগ্রহণমূলক কাজে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ প্রদান করার দক্ষতা, প্রয়োাজনীয় ক্ষেত্রে প্রশংসা করতে পারা, শিক্ষার্থীরা যাতে বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহী হয় এমন যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারা, শিক্ষার্থীদের পছন্দকে উৎসাহিত করার দক্ষতা, তাদেরকে বিকল্প কাজ বা ধারণা বা বিষয়বস্তু পছন্দ করার সুযোগ প্রদানের দক্ষতা, শিক্ষার্থীদেরকে পরস্পর সহযোগিতা করার পরিবেশ সৃষ্টি করার দক্ষতা ইত্যাদি। শিক্ষার্থীরা যদি তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পায় এবং সতীর্থকে বুঝাতে সক্ষম হয় তাহলে নিজেরা অনুপ্রাণিত, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও উৎসাহী হয়। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতির সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্যশীল হওয়ার দক্ষতা অর্জন করা। বিভিন্ন শিক্ষার্থী ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ক্রম অনুসরণ করে শিখে। যদি কোন শিক্ষার্থী শিক্ষকের দেওয়া প্যাটার্ণ অনুসরণ না করে ভিন্নভাবে শিখে, সেজন্য অধৈর্য্য হওয়া উচিত নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে ধৈর্য্যশীল হতে পারার দক্ষতা শিক্ষকের থাকা জরুরি। মনোবৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত আর একটি দক্ষতা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টির দক্ষতা অর্জন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারলে তারা পাঠ সহজে শিখে। আগ্রহী শিক্ষার্থীরা বেশি শিখতে পারে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার জন্য তাদেরকে বিষয়বস্তুর প্রতি আগ্রহী করতে হবে, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব অনুধাবন করাতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী উপস্থাপন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে, পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করতে হবে।

তাছাড়া শিক্ষার্থীদের শেখার ধরন অনুধাবনের দক্ষতা শিক্ষকের প্রয়োজন। শ্রেণির সকল শিক্ষার্থী একভাবে শিখে না। কেউ শিখে দেখে, কেউ শিখে শুনে আবার কেউ শিখে কাজ করার মাধ্যমে। কেউ শিখে আরোহী পদ্ধতিতে, কেউ শিখে অবরোহ পদ্ধতিতে। শিক্ষার্থীদের শেখার ধরন কী তা বোঝার দক্ষতা শিক্ষকের থাকতে হবে। আর শেখার ধরনের সাথে মিল রেখে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশল বাছাই করার দক্ষতা অর্জনের উপর এর কার্যকারিতা নির্ভর করে। সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থী শনাক্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারার দক্ষতাও মনোবৈজ্ঞানিক দক্ষতা। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের কিছু আচরণ বা কাজ নির্দেশ করে যে, শিক্ষার্থী সমস্যাগ্রস্ত আছে। যেমন- শিক্ষার্থীর নি¤œ গ্রেড প্রাপ্তি বা উচ্চতর গ্রেড পরিবর্তিত হয়ে নি¤œ গ্রেডে যাওয়া, অতি মাত্রায় অনুপস্থিতি, বিষণœ মেজাজ, ক্ষতিকর আবেগিক প্রতিক্রিয়া, খুব বিভ্রান্তিকর আচরণ প্রদর্শন ইত্যাদি। এসকল আচরণ দেখে সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষার্থী শনাক্ত করতে পারার দক্ষতা শিক্ষকের থাকতে হবে।

শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহারের দক্ষতার আর একটি ক্ষেত্র হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পাঠে অংশগ্রহণ করানোর দক্ষতা। এজন্য শিক্ষার্থীদের শ্রেণিতে কাজ করতে শেখাতে হবে। যে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষকের সামনে বসা কিন্তু সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে না কেবল কথা শুনে তাদেরকে সক্রিয়ভাবে কাজে অংশগ্রহণ করাতে হবে। শিক্ষার্থী যাতে তার ভুলের মাধ্যমে শিখতে পারে শ্রেণিতে সেরকম পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা শিক্ষকের কাজ ও দক্ষতা। শিক্ষার্থী প্রথম পদক্ষেপেই সব কিছু সঠিকভাবে শিখতে পারবে এমন আশা করা উচিত নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবে প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধন নীতি অনুসরণ করতে পারলে শিক্ষার্থীকে কাজে জড়িত রাখা সহজ হয়। সুষ্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করতে পারার দক্ষতা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতিকে কার্যকর করতে সহায়তা করে। যে কোন শিখন-শেখানো কাজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শিখনের শুরু থেকে সুস্পষ্ট হতে হবে এবং সকল কাজের নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের বোধগম্য হতে হবে।

সমস্যা সমাধান দক্ষতার যথাযথ অনুশীলন শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

জীবনের একটি আবশ্যকীয় দক্ষতা হচ্ছে কোন সমস্যা বুঝার সামর্থ্য এবং তা সমাধান করা। এই দক্ষতা অর্জন করা যায় অনুশীলনের মাধ্যমে। অতীতে শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষক একটি সমস্যা তুলে ধরে তা সমাধান করে দিতেন। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সামনে সমস্যা তুলে ধরা হয়। শিক্ষার্থী সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োগ করে তার সমাধান করেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষক নির্দেশকের ভূমিকা পালন করেন এবং শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করেন। অংশগ্রহণমূলক শিখনে স্বীকার করা হয় যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থী অন্যদের থেকে ভিন্ন এবং প্রত্যেকের আলাদা দক্ষতা ও সামর্থ্য রয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, সমস্যা সমাধানে কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নাই। একাধিক পদ্ধতিতে সমাধান করা যেতে পারে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সর্বোত্তম সমাধান খুঁজে বের করার সামর্থ্য থাকতে হবে। অংশগ্রহণমূলক শিখনে শিক্ষকের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এরকম পাঠ সংশ্লিষ্ট সমস্যা তুলে ধরে সমাধানে দক্ষ করা।

শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতিতে অনেক সময় শিক্ষক বক্তৃতার মাধমে পাঠের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন এবং শিক্ষার্থীরা নোট লিখে ও পরবর্তীতে না বুঝে মুখস্ত করে। কিন্তু বর্তমান কালে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, শিক্ষার্থী কী শিখছে এবং বাস্তব জীবনে তা কীভাবে কাজে লাগবে তা বুঝতে চায়। অংশগ্রহণমূলক শিখনের লক্ষ্য হচ্ছে, শ্রেণিকক্ষে শিখন এবং বাস্তব জগতের প্রয়োজনের সাথে যে তফাৎ তার মধ্যে সংযোগ সাধন করা। শ্রেণিকক্ষের শিখন ও বাস্তব জগতের পরিস্থিতির সাথে সংযোগ স্থাপনের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করানো শিক্ষকের কাজ। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতির একটি উদ্দেশ্যই হচ্ছে শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীদের পাঠে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোন একটি অংশকে কাজের বাইরে রেখে শিক্ষণ কাজ পরিচালনা করলে তাতে কার্যকর শিখন হবে না। শিক্ষকগণ অনেক সময় নিজের অজান্তেই বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই যারা সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে ভিন্ন তাদের দিকে সাড়া প্রদান করেন না বা তাদের এড়িয়ে যান। শারীরিক, মানসিক, আর্থনীতিক বা অন্য কোনভাবে পিছিয়ে পড়া বা যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরকে এড়িয়ে গেলে তা সম্পূর্ণভাবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হবে না। কাজেই শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।

অংশগ্রহণমূলক শিখনে এমনভাবে প্রশ্ন করতে হবে যাতে শ্রেণির সকলে সক্রিয় থাকে। এমন ধরনের প্রশ্ন করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের চিন্তা শক্তি বিকাশ লাভ করে। শিক্ষকের প্রশ্নকরণ এবং প্রশ্নের উত্তর প্রদান দক্ষতা শিক্ষার্থী কেন্দ্রিকপদ্ধতির প্রয়োগকে ফলপ্রসূ করতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে উচ্চতর ও উন্মুক্ত প্রশ্ন অধিক কার্যকর। শিক্ষার্থীদের উত্তরের ত্রুটি সংশোধন করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগে শিক্ষকের আর একটি প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র হচ্ছে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা। এর মধ্যে রয়েছে শ্রেণি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের কাজ পরিবীক্ষণ করতে পারা, সময় ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। শ্রেণিতে শিক্ষার্থী বসার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সকল বাহ্যিক পরিবেশ বা অবকাঠামোগত দিকের ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার্থীর মনোসামাজিক দিকের ব্যবস্থাপনা শ্রেণি ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। অংশগ্রহণমূলক শিখনের জন্য সারি ও কলামভিত্তিক নয়, গ্রুপভিত্তিক বা স্টেশনভিত্তিক বসানোর ব্যবস্থা করা ভালো। শিখন ব্যবস্থাপনার জন্য শিক্ষকের পরিবীক্ষণ দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক কাজসমূহ শিক্ষার্থীরা সঠিকভাবে করছে কিনা বা করলেও কতটা করতে পারছে, না পারলে তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দক্ষতা শিক্ষকের থাকতে হবে। সময় ব্যবস্থাপনা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতির প্রয়োগকে ধারাবাহিকতা প্রদান করে ও উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করে। একটি পাঠের জন্য মোট কত সময় বরাদ্দ সেই অনুসারে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা করে সময় বরাদ্দ করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই কাজটি শেষ করতে হবে। তবে প্রতিটি কাজের জন্য শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।

শিখন যাচাইয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি প্রয়োগের সফলতার মাত্রা নিরূপন করা যায়। শিখনের সাফল্য কেবল একটি মাত্র পরীক্ষার দ্বারা বা পিরিয়ডের শেষের দিকে কয়েকটি গতানুগতিক প্রশ্নের মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় না। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশলের মাধ্যমে পরিচালিত শিখন যাচাইয়ের জন্য ধারাবাহিক মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজ চলাকালীন এবং কাজ শেষে শিক্ষার্থীদের যাচাই করার দক্ষতা শিক্ষকের থাকতে হবে। এক্ষেত্রে দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন যথাযথভাবে শিখন যাচাইয়ের সহায়ক এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়নের যোগ্যতা শিক্ষকের থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উপরের বর্ণনা পাঠ করলেই বা অনুধাবন করলেই কি একজন শিক্ষক দক্ষতাসমুহ অর্জন করতে সক্ষম হবেন? দক্ষতাগুলি অর্জনের জন্য প্রয়োজন এ সম্পর্কিত সুস্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান, অনুধাবন করতে পারা এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে প্রতিটি দক্ষতা অর্জন উপযোগী করে। এছাড়াও দক্ষতা সম্পর্কিত জ্ঞান বা ধারণা অর্জন ও তা অনুধাবন করে পরিকল্পিত অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতাসমূহ অর্জন করা যেতে পারে। অনুশীলন প্রক্রিয়াটি চলতে পারে এভাবে- পরিকল্পনা প্রণয়ন, অনুশীলন, নানা কৌশলে ফিডব্যাক গ্রহণ, পুন:পরিকল্পনা প্রণয়ন, পুন:অনুশীলন ও পুন:ফিডব্যাক গ্রহণ। এভাবে চক্রাকারে অনুশীলন করার মাধ্যমে দক্ষতাসমূহ অর্জন করা সম্ভব হবে। দক্ষতাসমূহ অর্জন করতে পারলেই একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি ও কৌশলসমুহ প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবেন। যার ফলাফল হিসেবে পাওয়া যাবে গুণগত মানসম্পন্ন শিখন-শেখানো কার্যক্রম ।
মো. আবুল বাশার: উপাধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ফেনী।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029890537261963