শিক্ষার মান এখনো দুশ্চিন্তার কারণ

মো. জাকির হোসেন |

শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতি সম্প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দিনের প্রথম ও শেষ দুটি ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনাসহ ১৫টি নির্দেশনা দিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এর ঠিক দুই দিন পর ঢাকা কলেজের এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষার মান কমেনি। শিক্ষায় অনেক উন্নতি হয়েছে। আমাদের ছেলে-মেয়েদের মান অনেক উন্নত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেছেন, ইউনেসকোসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষার উন্নয়নে বাংলাদেশ রোল মডেল। শিক্ষার মান আর কতটুকু নিচে নামলে শিক্ষার মানহানির কথা স্বীকার করা হবে জানি না। নানা জটিল রোগে আক্রান্ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা শয্যাশায়ী রোগীর মতো আমাদের শিক্ষার মানও নানা রোগে-শোকে ভোগে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে লাইফ সাপোর্টে চলে গেছে—এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে শুধু দাফন-কাফন নয়, শিক্ষার মানের কুলখানি হতেও বেশিদিন লাগবে না।

মানের বেপরোয়া নিম্নগামিতা দেখে আমার একটা রূপক গল্পের কথা মনে পড়ছে। স্রষ্টা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি সম্পর্কে দেবতাদের বোঝাচ্ছিলেন যে সব কিছুই তিনি ভারসাম্য রক্ষা করে তৈরি করেছেন। দেবতাদের বোঝাতে স্রষ্টা উদাহরণ দেন, যেমন প্রতি ১০টি হরিণের জন্য আমি একটি সিংহ সৃষ্টি করেছি। আমি আমেরিকা বানিয়েছি, তাদের সম্পদ-ঐশ্বর্য দিয়েছি, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য তাদের সর্বদা উদ্বিগ্ন করে রেখেছি। আফ্রিকায় অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি দিলেও তাদের গতিবিধি সীমিত করে দিয়েছি, সব জায়গায় তারা যেতে পারে না। নেপালকে এভারেস্ট দিয়েছি, কিন্তু সমুদ্র থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত রেখেছি। এক দেবতা দাঁড়িয়ে স্রষ্টার কাছে জানতে চান, আপনার সৃষ্ট সেরা দেশ কোনটি? স্রষ্টা নিঃসংকোচে জবাব দেন, অবশ্যই বাংলাদেশ আমার সেরা সৃষ্টি। যেদিকেই তাকাবে, সেদিকেই প্রাণজুড়ানো সবুজের সমারোহ। এখানকার মানুষগুলো খুবই ভালো। অত্যন্ত নরম প্রকৃতির হৃদয় তাদের। কিন্তু আপনি যে বললেন, সব কিছুই ভারসাম্য রক্ষা করে তৈরি করেছেন, দেবতা আবারও প্রশ্ন করেন স্রষ্টাকে। স্রষ্টা মৃদু হেসে জবাব দেন, এখানেও ভারসাম্য রক্ষার কোনো ব্যত্যয় করা হয়নি। একটু লক্ষ করলেই দেখবে, ভারসাম্য রক্ষার জন্য তাদের কেমন শিক্ষা দিয়েছি। শিক্ষার নিম্নমানের কারণে বাংলাদেশে চাকরির জন্য বিদেশিদের ভাড়া করে আনতে হয়। বাংলাদেশে নিয়োগের বিজ্ঞাপন ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে প্রকাশ করতে হয়। দক্ষতার অভাবের কারণে একদিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে পুষতে হয় বিদেশিদের, আর অন্যদিকে চিকিৎসার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় বিদেশের মাটিতে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতে সরকার চালানোর জন্যও দক্ষ জনবল পেতে বিদেশে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে।

গল্পটি রূপক হলেও চিত্রটি অবাস্তব নয়। একদিকে লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার দেশে চাকরির সন্ধান করছে, ভিটামাটি বিক্রি করে বৈধ-অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, আর অন্যদিকে বাংলদেশের দরিদ্র অর্থনীতির হাজার হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স আকারে ও চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে বাইরে চলে যাচ্ছে। এক পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি প্রবাসী বছরে রেমিট্যান্স পাঠায় ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশের কোটি মানুষের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান, ইউক্রেনসহ আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার ৫৫টি দেশের লাখ লাখ কর্মী। বাংলাদেশে কতসংখ্যক বিদেশি নাগরিক কাজ করে তার সঠিক তথ্য সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতেই নেই। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। তাঁরা এক বছরে তাঁদের দেশে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান।

বাংলাদেশ ভারতে পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের বছরভিত্তিক আরেক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশের বাইরে চলে যাওয়া অর্থের পরিমাণ চার বিলিয়ন ডলার বা ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ অর্থ যাচ্ছে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে। এ ছাড়া কাজের অনুমোদনহীন অবৈধ বিদেশিরা অর্জিত অর্থ চোরাপথে হুন্ডির মাধ্যমে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। মানহীন মেডিক্যাল শিক্ষার দরুন সৃষ্ট অদক্ষতার জন্যও হাজার হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশিদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে দেশটি যে ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ ডলার আয় করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশি রোগীদের কাছ থেকেই আয় করেছে ৩৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার; অর্থাৎ প্রায় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত অর্থবছরে চার লাখ ৬০ হাজার বিদেশি রোগী ভারতে চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের মধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজার বাংলাদেশি; যার মানে চিকিৎসা নেওয়া বিদেশিদের প্রতি তিনজনের একজন ছিল বাংলাদেশি।

বিদেশি কর্মীরা গার্মেন্ট, কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল, ওভেন ও নিটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি, বায়িং হাউস, মার্চেন্ডাইজিং কম্পানি, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন হাউস, খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, চামড়াজাত প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনি সংস্থা, লজিস্টিকস, টেলিকম, বহুজাতিক কম্পানি, দেশি করপোরেট কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি হ্যাচারি ও সাধারণ ফার্নিচারের দোকানেও কাজ করছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ বিষয়ে পাঠদানের নিমিত্তে স্কুলে শিক্ষকতার জন্যও বিদেশিদের নিয়োগ করা হচ্ছে। একটি অসমর্থিত সূত্রমতে, সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করে এ দেশে। উচ্চ শিক্ষিতদের প্রায় অর্ধেক যখন বেকার তখন এ বিপুলসংখ্যক বিদেশির নিয়োগ আমাদের মানবসম্পদের দক্ষতার ঘাটতি বা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তাদের প্রস্তুতিহীনতার ইঙ্গিত দেয়।

বিপুলসংখ্যক বিদেশির সবাইকে আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতার ঘাটতির কারণেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তেমনটি নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাশন হিসেবে বা প্রতিষ্ঠানের কাটতি বাড়ানোর জন্যও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অস্বীকার করার জো নেই। তবে বেশির ভাগ নিয়োগই দক্ষতার ঘাটতিজনিত কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের একজন গ্র্যাজুয়েটকে যখন ৩০-৪০ হাজার টাকার মধ্যে নিয়োগ করা যায় তখন তাদের দক্ষতা সত্ত্বেও শুধু ফ্যাশন হিসেবে বা কাটতি বাড়ানোর জন্য চার-পাঁচ লাখ টাকা বা তার চেয়েও বেশি বেতন দিয়ে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অনেক উদ্যোক্তাকে প্রকাশ্যে বলতে শুনেছি, দেশে দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন পর্যাপ্ত জনশক্তি নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে সিগন্যাল বাতি দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করা হলেও আমাদের দক্ষতা এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি বাতিল করে দিয়ে হাত, লাঠি ও রশি পদ্ধতিতে আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চলছে। সমগ্র বিশ্বের তুলনায় আমাদের রাস্তা নির্মাণ ব্যয় কয়েক গুণ বেশি হলেও রাস্তার এক প্রান্ত তৈরি করে অপর প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই নির্মিত রাস্তায় শুধু খানাখন্দ নয়, কোথাও কোথাও ছোটখাটো ডোবা তৈরি হয়ে যায়। এডিপি বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবের কারণে বছরের মাঝপথে কাটছাঁট করতে হয় এডিপি বরাদ্দ। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় বেড়ে যায় প্রকল্প ব্যয়। কাজের গুণগত মানের কথা না-ই বা বললাম।

দশকের পর দশক ধরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়ে চলছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। অনেকেই হয়তো এ জন্য দুর্নীতিকে এককভাবে দায়ী করবেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করব। দুর্নীতি নেই পৃথিবীতে এমন দেশ বিরল। নানা গবেষণা বলছে, দুর্নীতির পাশাপাশি অদক্ষতাও ভর্তুকির অন্যতম বড় কারণ। এক পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৪ বছরে বিডাব্লিউডিবি, বিআইডাব্লিউটিএ, বিএডিসি, বিএসসিআইসি, বিজেএমসি, বিএসবি, ইপিবি, এনএইচএ, বিএসআরটিআই, আরডিএ ও বিআইডাব্লিউটিসি—এই ১১টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশি গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতার প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই ভিনদেশিরা বৈধ-অবৈধভাবে এ দেশের চাকরির বাজারে ক্রমবর্ধমান হারে জেঁকে বসছে। অদক্ষতা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে আমাদের অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট বাংলায় ও ইংরেজিতে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। ফলে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান যেটুকু অর্জন করেছে তা-ও প্রকাশ করতে না পারার কারণে নিয়োগ পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার নিয়োগ পেলেও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের প্রায়োগিক দক্ষতার অভাবে কর্মক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।

একসময়ের ভুবনখ্যাত তক্ষশীলা, বিক্রমশীলা, বিক্রমপুর, নালন্দা, রত্নগিরি, পুষ্পগিরি, জগদ্দল, অদন্তপুরি, সোমাপুরা, ভালাভি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উত্তরসূরি বাংলাদেশের শিক্ষার মান কেমন করে তলানিতে ঠেকল, তা অবশ্যই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও গবেষণার দাবিদার। তবে শিক্ষার সঙ্গে কয়েক দশকের আত্মীয়তার সম্পর্কের সুবাদে এটা অনুভব করতে পারি, দীর্ঘদিনের অনাদর আর অবহেলার ফলে নানা রোগে-শোকে ভুগে আজ এ অবস্থা। মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম পাঁচটি বিষয় অধিক গুরুত্বপূর্ণকে শিক্ষাদান করছে (শিক্ষকের মান), কাকে শিক্ষাদান করছে (শিক্ষার্থীর মান), কী শিক্ষাদান করছে (বিষয়বস্তু/সিলেবাস), কিভাবে শিক্ষাদান করছে (শিক্ষাদান পদ্ধতির কার্যকারিতা) ও মেধা যাচাই পদ্ধতি কেমন (পরীক্ষা পদ্ধতি)। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই পাঁচটি ক্ষেত্রেই বড় সমস্যা রয়েছে। প্রায়ই খবর বেরোয় প্রাইমারি, মাধ্যমিকের বিপুলসংখ্যক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না, গাইড বই দেখে প্রশ্ন করেন ইত্যাদি। তার মানে শিক্ষকদের একটি অংশ উপযুক্ত মানের নয়।

এ দেশে প্রাইমারি শিক্ষকের মর্যাদা তৃতীয় শ্রেণির আর মাধ্যমিকের শিক্ষকরা বছরতিনেক আগে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছেন। যে দেশ শিক্ষককে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেয়, সে দেশে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন দুরাশা নয় কি? পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আদলে শিক্ষা সার্ভিস কমিশন (ইএসসি) গঠন করে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গ্র্যাজুয়েটদের স্কুলের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা যেত। মেধাবী শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়নের সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রাইমারি ও মাধ্যমিকের সিলেবাস ও পরীক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তন নিয়ে যে তেলেসমাতি কাণ্ড চলছে তাতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা যে এখনো পড়াশোনার প্রতি পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেনি সে জন্য শুকরিয়া। পরীক্ষাপদ্ধতি একটি ছাঁকনি, যেটা গলিয়ে শিক্ষিতরা বেরিয়ে যাবে আর মূর্খরা আটকে থাকবে। শিক্ষার নীতিনির্ধারকরা ছাঁকনি ফুটো করে আমাদের স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের হাতে শুধু ছাঁকনির হাতলটা ধরিয়ে দিয়েছেন। ফলে মানের যা হওয়ার তাই হয়েছে।

অনেকেই একটা যুক্তিসংগত প্রশ্ন করতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ, সিলেবাস নির্ধারণ, শিক্ষাদান ও পরীক্ষা পদ্ধতিতে তো সরকার হস্তক্ষেপ করে না, তাহলে উচ্চশিক্ষার নিম্নযাত্রা কেন? এখানে নিম্নগামিতার কারণ স্কুল-কলেজ থেকে ভিন্ন। উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের নামে নানা বিবেচনায় যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তাতে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার নামে শিক্ষা-ব্যবসা চলছে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার দৈন্যদশা চলছে অন্যবিধ কারণে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ফলকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অন্যান্য সামরিক-বেসামরিক চাকরিজীবীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য-বঞ্চনা করা হয়েছে। কমপক্ষে ৫০ জন শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করে এটা অনুধাবন করেছি যে মানের নিম্নগামিতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বঞ্চনা ও বৈষম্যের  সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি তখন যাদের স্কুলে পড়তে দেখেছি তারা কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আর কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট হয়ে সামরিক-বেসামরিক সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেছে। এখন তারা সবাই সরকারি গাড়িতে করে অফিস যায়, তাদের সন্তান সরকারি গাড়িতে করে স্কুল-কলেজ-প্রাইভেটে পড়তে যায়, স্ত্রী-পরিজন সরকারি গাড়িতে বাজারে যায়। তাদের অনেকেরই প্রতীকী মূল্যে কোটি কোটি টাকা দামের সরকারি প্লট আছে, অনেকে আবার ডেভেলপার দিয়ে সরকারি প্লটে বাড়ি তৈরি করে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি করছে। সিটিং অ্যালাউন্স, রেশনসহ নানা ভাতার মাধ্যমে বেতনের প্রায় সমপরিমাণ আয় করছে।

সরকারের কাছ থেকে বিনা সুদে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে গাড়ি কিনে মাসিক ৪৫ হাজার টাকা রক্ষণাবেক্ষণ খরচ পাচ্ছে ও গাড়ির মালিক বনে যাচ্ছে। আর ওই একই স্কুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সন্তান যাচ্ছে বাস-টেম্পো-রিকশায় চড়ে। ছোট্ট একটা ভাড়া বাড়িতে নানা টানাটানিতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। সব কিছু চোখের সামনে দেখা। স্ত্রী-সন্তানের প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি কি না? যাঁরা এত বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তাদের চেয়ে কম শিক্ষিত কি না, কম অবদান রাখছেন কি না? নানা প্রশ্ন। চাওয়া ও চাপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিজেই রাষ্ট্র ও সরকারসৃষ্ট বঞ্চনা ও বৈষম্য মোচনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যাঁদের সুযোগ আছে তাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যাঁদের সে সুযোগ নেই তাঁদের কেউ কেউ প্রজেক্ট-কনসালট্যান্সি, শেয়ারবাজার, স্কুল-কলেজের জন্য বই লেখাসহ নানা পথ বেছে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তথাকথিত রাজনীতিও এসব বঞ্চনা-বৈষম্যেরই উপজাত। আর এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তথা শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক শিথিল হয়ে গেছে। শিক্ষকতা ব্রত থেকে পেশা তথা চাকরিতে রূপ নিয়েছে। উচ্চশিক্ষার প্রাণ গবেষণা লাটে উঠেছে। ফলে উচ্চশিক্ষা জাত-কুল-মান সবই হারিয়েছে। লাইফ সাপোর্টে চলছে শিক্ষার মান। ভেন্টিলেশন সাপোর্টে থাকা শিক্ষার সার্টিফিকেটধারী বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রীরা সহজেই মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ নানাভাবে বিভ্রান্ত করতে পারবে আমাদের যুবসমাজকে। এত বিপুলসংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত যুবসমাজ বিভ্রান্ত হলে পথ হারিয়ে ফেলবে বাংলাদেশ—এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030510425567627