শিক্ষার মান ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

বিশ্বজিৎ রায় |

আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে শিক্ষার মান।  এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রকাশিত ফলে যখন দেখা যায় যে গতবারের চেয়ে এবারের ফলাফল একটু কম হয়েছে তখন বলা হচ্ছে শিক্ষার মান একটু বেড়েছে। কিন্তু মান বাড়াতে গেলে যে বিষয় গুলির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া দরকার তা কি কেউ বলছে, বলছে না। সেসিপ দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিক খাত উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।  সারাদেশে কাজ করার জন্য সেসিপ নিজস্ব কিছু জনবল নিয়োগও করেছে। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছিল সে লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার দিন এসেছে। তবে শিক্ষার মান উন্নয়নে কিছু মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধন করতে চাই।

গত ১ জুন ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে মাননীয় অর্থ মন্ত্রী ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করেছেন তাতে মাধ্যমিক সেক্টরে তিনি বাজেট দিয়েছেন ২৩ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। গত বছর শিক্ষাখাত মোট বাজেটের ১১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল এ বছর তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করার কথা। আমাদের দেশে জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় এর স্থলে  ২ দশমিক ২ শতাংশ  ব্যয় হচ্ছে। এই বরাদ্দ দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তাবায়ন করা সম্ভব  হবে বলে বিশ্বাস হয় না।

জাতীয় বেতন কাঠামো ২০১৫ অনুযায়ী বেসরকারি শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন-ভাতাদি পাচ্ছে। জাতীয় বেতন কাঠামো যখন তৈরি হয় তখন ৪ সদস্য বিশিষ্ট সরকারি চাকরিজীবীদের পরিবার কী ভাবে চলবে তা চিন্তা করে বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়। তাতে অনাকাঙ্খিত ভাবে অন্তর্ভুক্ত হয় বেসরকারি শিক্ষকদের। অনেক নাটকীয়তা হয়েছিল এ নিয়ে। পরে মার্চ ২০১৬ এর এমপিওতে তা বাস্তবায়িত হয়। রয়ে যায় অনেক বেতন বৈষম্য। ২০১৫ বেতন গেজেট অনুযায়ী তারা শুধু বেতনটাই পান। অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কপালে পড়ে কুঠারাঘাত। তাছাড়া ২০১৫ সালে বেতন কাঠামো অনুযায়ী তারা ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সার্বজনীন ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা পাচ্ছে না। বেসরকারি শিক্ষকরা বৈশাখী ভাতা পেল না কিন্তু তাদের কে আড়ম্বরে  বৈশাখী উৎসব পালন করতে হল। অন্তর দিয়ে ভাবুন তো কী বিষয়টি? বেসরকারি শিক্ষদের অন্তর পুড়ে ছাই হচ্ছে। তারা আন্দোলন সংগ্রাম কম করল না। কিন্তু সরকারি তরফ থেকে কোন সায় পাওয়া যায়নি।  দুই এক জন বিষয়টি নিয়ে কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যে কোন কাজের জন্য মনস্তাত্ত্বিক বিষয় একটি বড় ব্যাপার। মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রেও তেমনি। বেসরকারি শিক্ষকরা ৮ বছর পূর্তিতে একটি টাইমস্কেল পেত, সেটা আজ বন্ধ। অথচ সরকারি চাকুরেদের ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে অটোমেশন চালু হয়েছে কিন্তু বেসরকারিরা অটোমেশন পাবে কী না তা অনিশ্চিত। সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা যে স্কেলে বেতন পান বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা সে স্কেলে পান না। দীর্র্ঘদিন ধরে আইসিটি শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছে না। কলেজ লেভেলের অনার্স পর্যায়ে যারা ক্লাস নেয় তারা বেতন ভাতা পাবে না। ভাবুন তো কিভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেবে। বিপণন ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষকদের ও একই অবস্থা। তারাও এমপিওভুক্ত হতে পারছে না। কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষরা তাদের অভিজ্ঞতার স্কেল পাচ্ছে না। ঈদ বোনাসের ২৫ শতাংশ ও ৫০ শতাংশ আজ ও পরিবর্তন হল না। ইত্যোমধ্যে অবসরভাতা ও কল্যাণ ট্রাষ্টের ফান্ডে অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যা শিক্ষকসমাজে হতাশার সৃষ্টি করেছে। আবার অবসর গ্রহণের পরও স্বস্তি নাই। অবসরে যেয়ে অনেকে ভাতা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এত এত বৈষম্য চলছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। সরকারি শিক্ষকদের সাথে একই সিলেবাস পড়িয়ে মানসম্মত শিক্ষার জন্য এতসব বৈষম্যেও নূন্যতম চাহিদা পূরণ করা দরকার।

১৭ জানুয়ারি ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশিত আইএমইডি এর  রিপোর্টে  প্রকাশ পেয়েছে। দেশে ১৮ হাজার ৪৫৩ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৮ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নেই। সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ নেই। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাচা ও সেমিপাকা স্থাপনায় শ্রেণিপাঠ দান চলছে। শিক্ষার্থীরা অনুপযোগী পরিবেশে পড়াশুনা করছে যা উন্নয়নের দরকার। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে সরকার ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সেকেন্ডারী এডুকেশন ডেভেলপমেণ্ট প্রজেক্ট নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নেয় যার একটি অপশন শিক্ষক প্রশিক্ষণ। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকল্পে শিক্ষক প্রশিক্ষণ দরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেধেছে হ-য-ব-র-ল। প্রজেক্টটির উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তুু তৃণমূল পর্যায় থেকে এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বিষয়ের শিক্ষক ট্রেনিংয়ে না পাঠিয়ে অন্য বিষয়ের শিক্ষক দ্বারা ট্রেনিং গ্রহণ করা হয়। যেমনঃ ইংরেজি বিষয়ের ট্রেনিং গ্রহণ করার জন্য যাচ্ছে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক, ইত্যাদি। আইসিটি সমৃদ্ধ জ্ঞান লাভ করার জন্য শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে প্রবেশ করতে হবে। দরকার ওঈঞ বিষয়ে সকল শিক্ষকের প্রশিক্ষণ। মানসম্মত শিক্ষা, শিক্ষকের মান বৃদ্ধি ও বিষয় ভিত্তিক ট্রেনিং এর জন্য এডুকেশন ডেভেলপমেণ্ট প্রজেক্ট এর নেওয়া   মহৎ উদ্দেশ্য বৃথা যাচ্ছে।

শিক্ষক নিয়োগে সরকারি স্কুল কলেজ মাদ্রাসার মত দীর্ঘসূত্রীতা দেখা যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ঘাটতি হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবেনা। দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি বছর খানেক সময় ধরে। এনটিআরসিএ থেকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থী কবে তাদের পদে যোগদান করবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক না থাকে তাহলে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কী শিক্ষবে, কী মানই বা অর্জিত হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ জ্ঞান লভের জন্য লাইব্রেরী হচ্ছে দর্পন স্বরূপ। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ’’ লাইব্রেরী ” নামক প্রবন্ধে জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যক্তিগত লাইব্রেরী গড়ে তোলার কথা বলেছেন।

দীর্ঘদিন  এমপিও বিহীন ৬ হাজার প্রতিষ্ঠানে ১ লাখের মত শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োজিত। এসব কর্মরত শিক্ষক কর্মচারি মানবেতর জীবন যাপন করছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কী ভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করবে। সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নে রয়েছে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা। সরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে যে ৪১ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারে না। এর একমাত্র কারণ বিদ্যালয় গুলোতে সৃজনশীলতার চর্চা কম এবং প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব। এসএসসি ২০১৭ সালের খাতা দেখার পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত জ্ঞানকে ঊৎসাহিত করে মুখস্থ নির্ভর পদ্ধতির দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে। এ পদ্ধতি শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বিকাশে বাঁধাসৃষ্টি করে এবং এটি মানসম্মত শিক্ষার অন্তরায়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০১২ রচিত বই গুলোতে আরও সৃজনশীল প্রশ্ন সংযোজিত হওয়া বাঞ্চণীয় ছিল। বইয়ের কলেবর কমালে শিক্ষার্থী যেমন উপকৃত হবে তেমনি এ সব বিষয়ে তাদের জানার মান ও আগ্রহ বাড়তো। বর্তমানে একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থ ৫০ থেকে শুরু করে তদুর্ধ্ব। একজন শিক্ষকের পক্ষে এতবড় ক্লাস পরিচালনা করা খুবই দূরহ। মান সম্মতশিক্ষা নিশ্চিত করতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ অনুযায়ী ১: ৩০  হওয়া  উচিত।

সব চেয়ে মোদ্দা কথা হলো মানসম্মত শিক্ষার জন্য সরকারি -বেসরকারি বেতন বৈষম্যসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। দৈনিক শিক্ষার সম্পাদক সময়ের একটি সাহসী উচ্চারণ করেছেন। তিনি শিক্ষকদের বেতন শিক্ষা মন্ত্রীর উপরে চাইলেন। তিনি আরও বললেন” শিক্ষকদের মান সম্মত ভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে, তারপর মান সম্মত শিক্ষার কথা চিন্তা করতে হবে ”।  বৈশাখী ভাতা এদেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজ পেলনা, কি তাদের অপরাধ? কেন বাদ পড়ছে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট থেকে। তাই শিক্ষা থেকে দুর্নীতিসহ বেতন বৈষম্য দূর করে মান সম্মত বাচার পথ সুগম করে মান সম্মত শিক্ষা ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্বজিৎ রায়: শিক্ষক, তালা, সাতক্ষীরা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha মাকে ভরণপোষণ না দেয়ায় শিক্ষক গ্রেফতার ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031299591064453