এবারে শীত পড়ছে সব রেকর্ড ভেঙে। বাংলাদেশের প্রবীণ মানুষও এ দেশে এমন হাড়কাঁপানো শীতের কবলে কখনও পড়েনি। সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত শীতের কামড়ে। দিনভর কুয়াশা, সুর্যি মামার দেখা মেলা ভার। শীত-গরমের খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা আরও বলছেন, এবারের শীতের নাকি কেবল শুরু। তেঁতুলিয়ায় প্রায় আড়াই ডিগ্রি (২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় কী করে লোকজন বেঁচে আছে, তা কল্পনা করাও কঠিন। এমনিতেই এই এলাকা মঙ্গা আক্রান্ত, গরিবের সংখ্যা বেশি। কী করে বেঁচে আছে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার সব হারানো মানুষরা? ঢাকা শহরে প্রায় অর্ধেক রিকশাওয়ালার বাড়ি এই উত্তরবঙ্গে। পেটের দায়ে তারা বউ-বাচ্চা ফেলে রাজধানীতে এসেছে গতর বেচে বেঁচে থাকার আশা নিয়ে। তাদের দুঃখের কথা কল্পনা করা কঠিন।
দেশের উন্নতির জাহাজে এখন পালের বদলে ইঞ্জিন। তাই সে পালের জাহাজের মতো মন্দাক্রান্ত নয়, একেবারে যুদ্ধজাহাজের মতো তীব্র গতিসম্পন্ন। সেখানেই শেষ নয়। সে ইঞ্জিন জাহাজের যারা কাপ্তান তারাও ভীষণ দড়। আমরা অন্তত সে কথা শুনে শুনে হয়রান।
এদিকে কোনো কথাই যখন কারও কানে ঢোকে না, তখন দেড় লাখ বর্গকিলোর নিরুপায় মানুষ এসে জড়ো হয় ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায়। তাতে তাদের দুঃখের কথা কোন কান পর্যন্ত পৌঁছায়, একমাত্র মাবুদ জানেন। কিন্তু যারা খবর বিক্রি করে পেট চালান, তাদের কষ্ট একটু লাঘব হয়। পেটের দায়ে এই যে জীবন বাজি রেখে মানুষকে খবর দেওয়া, সেই কষ্টের জীবনে একটু সুযোগ পাওয়া সেটাই-বা কম কিসে? তবে আমি নিশ্চিত, খুব বেশি দিন এ সুযোগ আর মিলবে না, না খবর কইয়েদের, না খবর বানিয়েদের। জারি হবে কঠিন হুকুম, এ তল্লাটে ওসব নখরামি চলবে না।
আপাতত সে হুকুম জারি হয়নি। তাই সেখানে খ্রিষ্ট বছর শেষ হলো ওস্তাদজিদের আর্তনাদ আর অনাহারে। নতুন খ্রিষ্ট বছরেও তা শেষ হলো না। নজিরবিহীন শীতে তারা নজিরবিহীন কষ্ট স্বীকার করে না খেয়ে সেখানে পড়ে আছেন। শুধু এই আশায়, অন্তত তাদের ছা-বাচ্চাদের দিকে দয়া করে হলেও তাদের গতর খাটার ন্যায্য না হোক, কিছু পয়সা অন্তত তারা পাবেন সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে।
ক’দিন আগে অনশনী নন-এমপিও ওস্তাদজিদের আশ্বাস দেওয়া হলো, আশ্বাসবাণী শোনালেন এক-আধলা গোছের রাজকর্মচারী যে, তাদের মোনাজাত কবুল হয়েছে। তারা পাওয়ার আনন্দে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে, সালাম জানিয়ে ঘরে ফেরার আগেই বিদেশ ঘুরে এসে খাজাঞ্চিকর্তা শোনালেন, ওসব কাঁদুনে কথায় যেমন ভবি ভোলে না, তিনিও ভুলবেন না। যা হোক, আমাদের জ্ঞানগম্মি হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি, খাজাঞ্চিকর্তার ওপর ছড়ি ঘুরানো এমন তাকত খুব কম লোকেরই আছে।
এদিকে মাদ্রাসার মৌলবিরাও রাস্তায়, ওই প্রেস ক্লাবের সামনেই আর্তনাদ করছেন, আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছেন, যেন তাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার মেলে। এক দৈনিক ‘তেত্রিশ বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ধার করে লম্বা খবরের শিরোনাম করেছে। সেখানে এক বঞ্চিত মৌলবির ব্যথা-বেদনার কথা বাগ্ধময় হয়েছে। আরেক দৈনিক ক্রন্দসী রমণীর ছবি ছেপে সাধারণ মানুষকে চোখের জলে কঁাঁদিয়েছে। এমনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব মর্মস্পর্শী ছবি এবং কাহিনী প্রচার হচ্ছে, তাতে পাষাণ গলে যেতে পারে; কিন্তু আমাদের খাজাঞ্চিকর্তার পাষাণ হৃদয়ে সামান্য আঁচড় কাটবে বলে মনে হয় না। তার একই কথা, তিনি ওসব রাবিশ দাবির তোয়াক্কাই করেন না (এই লেখা যখন শেষ করেছি এমন সময় খবর এলো, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকরা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে পানি পান করে অনশন শেষ করেছেন)!
আজ বছরের পহেলা মাসের দ্বিতীয় পক্ষ শুরু হলো। গতকালই আবার জাতীয়করণের দাবিতে ওই প্রেস ক্লাবের সামনে এই তীব্র শীতে বসেছেন আরেক দল ওস্তাদজি। প্রভুদের করুণার আশায়। কিন্তু মনে হচ্ছে না তাতে খাজাঞ্চির পাষাণপ্রাকার খুলবে। কেননা, ভদ্রলোকের একই কথা, সব দাবিই নাকি রাবিশ! তাহলে কার দাবি আসল? হ্যাঁ, তাদের দাবি যারা গতরখাটাদের ডলারে উপচেপড়া রাজকোষ থেকে মালপানি সরিয়ে দিব্যি আছে। তাদের নাকি সবাই চেনে, শুধু ভাসুরদের নাম বলা নিষেধ! আর যারা সোনা, রূপা নামের বাহারি সব ব্যাংক লুটে নিতে পেরেছে, তাদেরও নাম উচ্চারণ করা যাবে না। তবে চাষাদের নামে ব্যাংক বানিয়ে তা লুটের যে খবর বেরিয়েছে, তাতে সারা দুনিয়ার আক্কেল গুড়ূম!। কিন্তু এই নব্য বঙ্গ শেঠদের সঙ্গেই পুরনো কেরানি-টার্নড-উজিরের মহব্বত বেশি। তাই তারা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। এদিকে খবর বেরিয়েছে, দুদক নাকি খুঁজে পেয়েছে ‘ছোট বেতনের এক মোটা চোরের’, আদালতে মোকদ্দমাও ঠুকেছে। চিকন আলীদের ফাঁসানো সহজ, ফাঁসিতে লটকানো আরও সহজ। কিন্তু মোটা আলীদের বেলায় জালও নেই, ফাঁসও নেই।
সবচেয়ে দামি কথায় গান বেঁধেছেন জ্ঞানমন্ত্রক। সেখানে যেসব কেরানিকুলের বাস, তারা মন্ত্রীপ্রবরের মগজ ভালোই ধোলাই করেছেন। তার শ্রেষ্ঠ আবিস্কার, লখিন্দরের বাসরঘরের সব ফুটো তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন, শুধু পেরে উঠছেন না নচ্ছার ওস্তাদজি আর প্রযুক্তির সঙ্গে। এবার তাই অভিনব সব ফরমান জারি করেছেন, তাতে নাকি লখিন্দরের বাসরঘরে ঢুকে প্রশ্ন ফাঁস করে এমন নাগিনী আজও জন্মেনি। যদি তেমন বিশ্বকর্মার খোঁজ সত্যিই তিনি পেয়ে থাকেন, সেই প্রযুক্তিও আবিস্কার করতে পেরে থাকেন, তাহলে আমরা আগাম তাকে অভিনন্দন জানিয়ে রাখছি। অন্তত আমরা যারা ছাপোষা সাধারণ মানুষ, আমাদের আদরের সন্তানদের সোনার ভবিষ্যৎ বারবার ঘুঘু এসে খেয়ে যাবে, তা আমরা মানতে রাজি নই। আমাদের একটাই আরজি, প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করতে হবে।
দেশ ভিক্ষুকমুক্ত। অন্তত সরকারি ঘোষণা তাই বলছে। দেশ ভরে গেছে ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা’ বিজ্ঞাপনের মোড়কে। বিজয় সরণির সবচেয়ে দামি জায়গায় কিংবা শাহবাগে গণজাগরণ চত্বর বা পল্টন স্কয়ার ইত্যাদি রাজধানীর সব গুরুত্বপূর্ণ স্থান ‘ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা’ সাইনবোর্ডে সয়লাব। এসব হলো ক্ষমতার নাভিকেন্দ্র। আমার আসা-যাওয়ার পথে রোজ কয়েক ডজন ভিক্ষুকের কাতর আবেদন শুনতে হয়, দেখতে হয়। এমনকি যারা বয়সের ভারে চলতে অক্ষম, তারাও লাঠি ভর করে বিজয় সরণির উঁচু ফ্লাই ওভারে উঠে যান; আটকে পড়া আয়েশী যাত্রীদের যদি করুণা হয়, যদি তাদের কাছ থেকে কিছু পাওয়া যায়, সেই আশায়। সারাদেশ ভিক্ষুকমুক্ত অথচ প্রশাসনের নাকের ডগায় ভিখ মেগে যারা বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা করছেন, তাদের কেউ চোখে দেখতে পান না, তা ভাবা কঠিন। তাদের হেফাজতের ব্যবস্থা করার মতো টাকাকড়ি খাজাঞ্চিতে অভাব, এ কথাই-বা মানি কী করে? আমাদের খাজাঞ্চি তো অশিক্ষিত-আধা শিক্ষিত, অদক্ষ প্রবাসী, মেয়ে দর্জি আর চাষির হাড়ভাঙা খাটুনির পয়সায় উপচে পড়ছে। তাই সেই উপচেপড়া টাকা ডলার বানিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে আমাদের সোনার দেশকে যারা হীরার দেশে রূপান্তর করছে, তাদের জন্য আমরা জান কোরবান করতে হামেশা তৈরি। কিন্তু দেশে দুস্থরা ভিখ মাগার কষ্ট থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেন? একজন আকাশমন্ত্রী মাটিতে নেমে বলেছেন, উঁচু আকাশের চেয়ে মাটির পৃথিবী ঢের ভালো। এখানে এই মাটির মানুষদের সঙ্গে গলাগলি করেই তো জীবন কাটিয়েছেন। আকাশ তাই ভালো লাগছিল না তারও। সমাজের কল্যাণে এবার নিশ্চয়ই সর্বহারাদের ভিক্ষে করে বেঁচে থাকার কষ্ট লাঘব হবে।
এদিকে বাজারে চাউর আছে, খাজাঞ্চিকর্তা আর জ্ঞানকর্তার সঙ্গে তরজা শেষ হচ্ছে না বলেই নাকি ওস্তাদজিদের মজুরি মিলছে না। এটা সত্যি কিনা, মাবুদ জানেন। তবে খাজাঞ্চিকর্তার সঙ্গে জ্ঞানকর্তার যত অমিলই থাক, একটা জায়গায় তাদের একবারে গলায় গলায় মিল। সেটি হলো, ওস্তাদজিদের শাসানো, শাপ শাপান্ত করা। আরও এক জায়গায় তারা একই নৌকার যাত্রী। একজন যেমন শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক লোপাটকারীদের রক্ষায় সদা ব্যস্ত, অন্যজন ব্যস্ত বিদ্যাবাণিজ্যের সিন্দাবাদদের কোচিং সেন্টার নামক অভিনব জ্ঞান বিতরণী কেন্দ্র আর সৃজনশীল কায়দা লিখিয়ে মুনশিদের রক্ষায়!
তা তারা করতেই পারেন। সেটাই তাদের পবিত্র দায়িত্বও হয়তোবা। আমরা আদার বেপারী ওসব জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কী! তারা আর এরাই তো কড়ি আর এলেম খাজাঞ্চির মিলিজুলি মালিক-মোক্তার!
আমিরুল আলম খান: সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড