সেই প্রধান শিক্ষক হেলালের আরো যত অপকীর্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

একের পর এক অভিযোগ। অপরাধের পর অপরাধ। তাতে বারে বারে হয়েছে ‘কৈফিয়ত তলব’। কিংবা ‘সাময়িক বহিষ্কারও’। তবে প্রভাবের জোরে বার বার অভিযোগের দোষ স্বীকার, কৈফিয়তের জবাব, ক্ষমা প্রার্থনা ও শাস্তি প্রত্যাহারের ফাঁক-ফোকরে পার পেয়ে গেছেন তিনি। খিলগাঁও গভ. স্টাফ কোয়ার্টার হাই স্কুলের সেই প্রধান শিক্ষক সরদার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। বার বার পার পেয়ে যাওয়ায় ক্রমেই বাড়তে থাকে তার অন্যায়, অত্যাচার, অসদাচরণ, বিকৃত রুচি, শিক্ষিকা-ছাত্রীর শ্লীলতাহানি, ইভটিজিং, গালাগালি, অর্থ লুট, শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা। গত ১৩ই জুন স্কুলের এক খণ্ডকালীন শিক্ষিকাকে ফাঁদে ফেলে দিনদুপুরে চলন্ত রিকশায় প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরে শ্লীলতাহানি করেন। তাকে নানাভাবে বিশ্রী কথাবার্তা ও অঙ্গভঙ্গিতে যৌন নিপীড়ন করেন। তখন বারবার বলতে থাকেন, ‘এসবে লজ্জা পেতে হয় না। কাউকে কিছু বলতে হয় না’। এছাড়া অন্তরঙ্গ সময় দেয়ার বিনিময়ে ওই শিক্ষিকাকে কু-প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। শ্লীলতাহানির ঘটনায় ১৪ই জুন খিলগাঁও থানায় ভিকটিমের মামলা দায়েরের পর গ্রেপ্তার হয়ে এখন শ্রীঘরে ওই প্রধান শিক্ষক।

ওই খণ্ডকালীন শিক্ষিকা বলেন, আমার বাবার বয়সী একজন প্রধান শিক্ষক নানা অশ্লীল কু-প্রস্তাবের পাশপাশি নিবিড়ভাবে আমার শরীর স্পর্শ করেন। রাস্তায় প্রকাশ্যে বিকৃত যৌন নিপীড়ন করেন। আমার সঙ্গে যোগ দেয়া অপর দু’নারী শিক্ষকের প্রতিও ছিল কু-দৃষ্টি। বাদ যায়নি ছাত্রীরাও।

প্রধান শিক্ষক হওয়ার আগে তিনি একই স্কুলে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। পরে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হন। কর্মরত রয়েছেন প্রায় দেড় যুগ। তখন থেকেই চলে আসছে শিক্ষিকা, কর্মচারী, বহিরাগত ও ছাত্রীর প্রতি তার বিকৃত রুচির যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানি। বিকৃত রুচির ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অঙ্গভঙ্গি ও দেহ সৌষ্ঠব প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রায় ছাত্রদের বাদ দিয়ে শুধু ছাত্রীদের দিয়ে নাচ, গানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান করানোর অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। ২০১৫ সালে ব্যবহারিক শিক্ষার ক্লাসে তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছাত্রীদের ওড়না খুলে বুক ডাউন ও ডিগবাজি দিতে বাধ্য করেছিলেন। এতে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে গেলে ওই বছরের ৩০শে মার্চ তৎকালীন প্রধান শিক্ষকের কাছে ছাত্রীরা লিখিত অভিযোগ করে। এর আগে ২০১১ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ছাত্রদের পিতৃ পরিচয় তুলে অশালীন কথা বলার জন্য ওই ক্লাসের ১৩ শিক্ষার্থীও তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল। এ ঘটনায় বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক এই হেলাল উদ্দিনের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। তাতে উল্লেখ করা হয় ‘আপনাকে বার বার মৌখিক সাবধান করার পরও ষষ্ঠ শ্রেণিতে অশালীন আলোচনা করেন…’। এ ঘটনায় পরবর্তী ১৯শে সেপ্টেম্বর ক্ষমা চেয়ে পার পান তিনি। একই বছরের সেপ্টেম্বরে অপর এক ছাত্রের সঙ্গেও অশালীন আচরণ করেন। এ ঘটনায় ওই ছাত্র ১৭ই সেপ্টেম্বর আরো একটি লিখিত অভিযোগ করেছিল। এ ছাড়া গত ১৪ জুন ওই শিক্ষিকার মামলার পর স্কুলটির ২০ ছাত্র-ছাত্রীও বিভিন্ন সময় নানাভাবে অশ্লীল আচার-আচরণ ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে খিলগাঁও থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। এ ছাড়া কারণে-অকারণে ছাত্রীদের গায়ে হাত দেয়া, স্কুলের সিসি ক্যামেরায় শিক্ষিকা ও ছাত্রীদের ছবি জুম করে দেখা ও যৌন ক্রিয়া-প্রসব বিষয়সহ অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা তার প্রতিদিনের আচরণ।

শুধু যৌন নিপীড়নই নয়। স্বেচ্ছাচারিতা, অসদাচরণ ও শৃঙ্খলাভঙ্গ তার নিত্য দিনের ঘটনা। অর্থ লুটের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে বিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রধান শিক্ষকের যোগসাজশে তিনি বিদ্যালয়ের বাইরে গিয়ে ৩৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর ফরম পূরণের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তাকে নোটিশ করেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। এ ছাড়া সম্প্রতি এক শিক্ষকের কাছ থেকে নিয়োগের নামে বড় অংকের টাকা উৎকোচ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

তার অসদাচরণ ও শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় বিব্রত শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘ দিন বিনা অনুমতি বা ছুটিতে স্কুলে অনুপস্থিত থাকাসহ বিদ্যালয়ের স্বার্থ পরিপন্থি কাজ ও অসদাচরণের অভিযোগে পরিচালনা কমিটি তাকে ২০০৮ সালের ১৮ ও ২৯শে নভেম্বর  এবং ২০০৯ সালের ১২ই জানুয়ারি কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করেছিল। কোনোটার জবাব না দেয়ায় ২৫ জানুয়ারি চূড়ান্ত নোটিশ ইস্যু। তারও জবাব না দিলে পরিচালনা কমিটির ১২ মার্চের সভায় তাকে বিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৮শে জুলাই আর কোনো অপরাধ না করার অঙ্গীকার করে তিনি বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেন। সে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৫শে অক্টোবরের সভায় কমিটি তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে। তারপরও থামেনি তার দৌরাত্ম্য। অপরাধের মাত্রা। ২০১২ সালে আবার শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য তাকে নোটিশ করা হয়। জবাবে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ওই বছরের ২১শে এপ্রিলের সভায় তাকে আবার ক্ষমা দেয় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি।

২০১৫ সালের ২৭শে জানুয়ারি তাকে প্রায় সময় কাউকে না জানিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগের জন্য কৈফিয়ত তলব করা হয়। জবাবে ৩১শে জানুয়ারি দুঃখ প্রকাশ করে পার পান। বিদ্যালয় বা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্য তাকে নোটিশ করা হয় একই বছরের ২১শে জুলাই। তাছাড়া বিদ্যালয়ে আসা ও যাওয়ায় মিথ্যা সময় লেখা, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করা, নোটিশ গ্রহণ না করাসহ কয়েকটি অপরাধের জন্য ২০০৮ সালের ২৯শে নভেম্বর তাকে আরো একবার কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করা হয়।

স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছাত্র ছায়ায় থেকে এতসব অপরাধের পরও তিনি বার বার পার পেয়ে গেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকলেও তিনি কমিটির যোগসাজশে নানা অপকৌশলে ও প্রভাব খাটিয়ে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন হন। গত বছরের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। এখানেও রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। এর আগে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রার্থী ছিলেন ৪০ শিক্ষক। আর স্কুল থেকে প্রার্থী ছিলেন সরদার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। ৮০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ১৬ নম্বর। ৪০ জনের মধ্যে হন ৩৭ তম। তারপরও কমিটি ও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। ৬৭ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জনকারী প্রার্থী শহীদুল ইসলামকে টপকে অসদুপায়ে কৌশলে প্রথম করিয়ে দেয়া হলো হেলাল উদ্দিনকেই। এরপর সহকারী শারীরিক শিক্ষক থেকে তিনি স্কুলটির প্রধান শিক্ষক। আর নিয়োগ পরীক্ষার খারাপ ফলের প্রমাণ লোপাট করতে খাতাপত্রসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রগুলো স্কুল থেকেই সরিয়ে ফেলা হয়। প্রধান শিক্ষক হলেও সেই দায়িত্বপূর্ণ পদ তার মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারেনি। লোপ পায়নি চারিত্রিক নোংরামিও। বরং তা আরো বেপরোয়া আকার ধারণ করে।

ওই বিদ্যালয়ের সপ্তম ও দশম শ্রেণির ৮জন ছাত্রী বলেন, কারণে-অকারণে যখন তখন গায়ে হাত দেয়া, অশ্লীল ব্যবহার, অশালীন কথা-বার্তা, গালিগালাজ, সিসি ক্যামেরায় ছাত্রীদের ছবি জুম করে দেখা এসব তার প্রতিদিনের কাজ।

ওই বিদ্যালয়ের ৫ শিক্ষক বলেন একই কথা। শিক্ষকের কোন গুণ নেই তার মধ্যে। তার বিকৃত রুচি ও অসদাচরণের কারণে সবাই অতিষ্ঠ। শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে চায় না। তবু তিনি প্রধান শিক্ষক। ‘গাঁয় না মানে আপনি মোড়ল’। তার অন্যায় আচরণ ও ব্যবহারের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা বহুবার তাকে মারতে উদ্ধত হয়েছে। তা থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য কক্ষের আগের ফটকে প্রায় সময় তালা দিয়ে রাখতে হয়।

বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আলমগীর চৌধুরী বলেন, আগে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ আমাদের কানে আসেনি। এখন বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষিকার শ্লীলতাহানির পর তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0057568550109863