স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ

মাছুম বিল্লাহ |

সরকারি-বেসকারি যেকোনো কলেজই হোক, সেখানে আমরা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দেখতে পাই—অর্থাৎ বাংলার শিক্ষক সেখানে বাংলা পড়াচ্ছেন, ইংরেজির শিক্ষক ইংরেজি আর পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছেন। কিন্তু মাধ্যমিক পর্যায়ে বাস্তব কিছু কারণে বিদ্যালয়গুলোয় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই।

সেখানে দেখা যায়, কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক অঙ্ক করাচ্ছেন আর বিকম পাস একজন শিক্ষক ইংরেজি পড়াচ্ছেন, সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক বাংলা পড়াচ্ছেন। তবে দেশের খ্যাতনামা মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক আগ থেকেই বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন বিষয়ে এগিয়ে থাকে। তারা মাস্টার ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকার ফলে তাদের জানার পরিধি একটু বেশি থাকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এটি একটি বৈষম্য, যদিও এককভাবে এটির জন্য কাউকে আমরা দায়ী করতে পারছি না। তবে সরকার অতিসম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে, যেটিকে আমরা একটি প্রয়োজনীয় ও উন্নত পদক্ষেপ বলতে পারি।

প্রস্তাবিত, এমপিও এবং জনবল কাঠামো নির্দেশিকায় বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। আর এটি চূড়ান্ত হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নতুন করে লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরির সংস্থান হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। নীতিমালায় দুটি অংশ রয়েছে। এর মধ্যে জনবল নিয়োগসংক্রান্ত দিক, আর বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের দিক। বৈঠক সূত্র জানায়, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি, বিদ্যমান লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও বা বেতন-ভাতাসহ প্রাসঙ্গিক আর্থিক সুবিধার বিভিন্ন দিকে বড় ধরনের পরিবর্তনের নির্দেশনা রয়েছে। নিম্ন-মাধ্যমিক স্কুলে বর্তমানে বাংলা, ইংরেজি ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য একজন করে শিক্ষক নিয়োগ করা যায়। কিন্তু নতুন প্রস্তাবনায় এ তিন বিষয়ের জন্য তিনজন করে শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে, যেটি একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক। বিশাল এক শ্রেণিতে একজন শিক্ষকের শিক্ষাদান সব সময় ফলপ্রসূ হয় না। কারণ শ্রেণিতে বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কর্যক্রমে অংশগ্রহণ করাতে হয়; কিন্তু শ্রেণির সাইজ বিশাল হলে সেটি আর সম্ভব হয় না। মাস্টার্স পাস করা শিক্ষকও এখন পাওয়া যাচ্ছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে বর্তমান নিয়মানুযায়ী বাংলা, ইংরেজি, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য তিনজন করে শিক্ষক পাওয়া যায়। এখানে আরো একজন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বাড়তি এ শিক্ষক হবেন ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের। গণিতের জন্য আলাদা শিক্ষকের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব আছে এতে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রথমবারের মতো শারীরিক শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং চারু ও কারুকলা বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে এর আগে শরীরচর্চা শিক্ষক যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে গণ্য হবেন। বাকি দুই বিষয়ের শিক্ষক নেই। এসব বিষয়ে শিক্ষক দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।

স্কুল ও মাদরাসায় কৃষি ও গার্হস্থ্য আলাদা বিশেষায়িত বিষয়, কিন্তু তা একই শিক্ষককে পড়াতে হচ্ছে। নতুন নীতিমালায় গার্হস্থ্য বিষয়ের জন্য আলাদা শিক্ষকের প্রস্তাব আছে। মাদরাসায় দাখিলে যেখানে এর আগে কম্পিউটার শিক্ষক নেই, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের জন্য শিক্ষক দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। কম্পিউটারের এই যুগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতান্তই বাস্তবিক, তবে সিদ্ধান্তটি শিগগিরই কার্যে রূপান্তর করতে হবে। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল, দাখিল ও আলিম পর্যায়ের মাদরাসায় বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন একজন। তিনিই পদার্থ, জীববিদ্যা ও উচ্চতর গণিত পড়াতেন। নতুন প্রস্তাবনায় ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞনের জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। চমৎকার সিদ্ধান্ত।

নীতিমালায় মোট ১১ ধরনের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সারা দেশে ২৬ হাজার ৯০টি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে আরো এক লাখ দুই হাজার ৬৭৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর নতুন পদ সৃষ্টি হবে। তবে এতে অনার্স-মাস্টার্স কলেজ, অনার্স ও কামিল মাদরাসা, সংগীত কলেজ, শরীরচর্চা কলেজ, চারুকলা কলেজ, গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ও নৈশকালীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মোট ৯ ধরনের প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উল্লেখ্য, এমপিও প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নির্দেশিকা শীর্ষক এ নীতিমালা ১৯৯৫ সালে প্রণীত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে আধুনিকতার ছাপ পড়েছে দেশে ও দেশের বাইরে, বিএড প্রশিক্ষণে সেগুলোর রিফ্লেকশন নেই বললেই চলে। তা ছাড়া যেকোনো প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ক্লাস ফলোআপ করতে হয়। বিএড করে আসার পর কোনো টিটি কলেজ থেকে শিক্ষকের ক্লাস কেউ ফলোআপ করতে আসেন না। কাজেই প্রশিক্ষণে অর্জিত বিষয় কি ক্লাসে কাজে লাগানো হচ্ছে বা হচ্ছে না কিংবা কোথায় ফিডব্যাক দরকার তার কোনো ব্যবস্থা বিএড প্রশিক্ষণে নেই। আধুনিক মাস্টার্স পাস শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মাধ্যমে আধুনিক যুগের শিক্ষকতা ও প্রশিক্ষণের বিভিন্ন বিষয় জেনে থাকেন। তাই এসব বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বিএডের চেয়ে মাস্টার্স পাস করা শিক্ষকদের ওপর জোর দেয়।

বেশ কয়েক বছর আগেও কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা কেউই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চাইতেন না। একে তো এই পেশা আকর্ষণীয় করা যায়নি, দ্বিতীয়ত ওপরে ওঠার সিঁড়ি নেই। তখন মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ বা পাওয়ার চিন্তা করা যেত না। আর তাই বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ছাড়া সব ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক ইসলামিয়াত পড়াতেন, আবার কমার্সের শিক্ষক ইংরেজি পড়াতেন। এটি অবশ্য এখনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিদ্যমান। সময় পাল্টেছে। এখন মাস্টার্স পাস করা অনেক প্রার্থীই মাধ্যমিকের শিক্ষকতা পেশায় আসছেন, শিক্ষকতার অবস্থাও আগের তুলনায় অনেকটাই উন্নত হয়েছে। মাস্টার্স পাস করা একজন শিক্ষক যখন ষষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে পড়াবেন, তখন তার চিন্তা-চেতনা ও ধারণা অনেকটাই উন্নতমানের হবে। কয়েক বছর আগে আমি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম, একদল শিক্ষক কেউ হাতে এবং কেউ বগলে বেত নিয়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটছেন। আবার কিছুসংখ্যক শিক্ষক দেখলাম, তাঁদের হাতে কোনো বেত নেই।

অন্য আরেকটি অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একই শ্রেণির একদল শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাস করে এসেছে। সৈয়দ আলী আহসানের কবিতা ‘আমার পূর্ব বাংলা’—এটি একটি একমাত্রিক কবিতা, শুধু একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুনলাম, পরে জানতে পারলাম, ওই শিক্ষার্থী একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজ থেকে পাস করে এসেছে, যেখানে মাস্টার্স পাস করা শিক্ষকরা তাদের পড়াতেন। আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। সেটি হচ্ছে, নবম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে ‘নার্সিং অ্যাজ এ জব’ নামে একটি চ্যাপ্টার ছিল। সেখানে লেখা ছিল—‘একজন নার্স হওয়ার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে’ দুই বছরের নার্সিং কোর্স করতে হয়। অথচ প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার পাশাপাশি চার বছরের নার্সিং ডিপ্লোমা কোর্স আছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা যেসব শিক্ষক প্রতিষ্ঠানে ক্লাস নিতেন, তাঁরা শিক্ষার্থীদের এ বিষয়টি অবহিত করতেন, বাকি সব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ওই দুই বছরের নার্সিং কোর্সের কথাই শিখিয়েছেন। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের এগুলো হচ্ছে পজিটিভ ও নেগেটিভ দিক। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই এবং দ্রুত এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046172142028809