স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শিক্ষকদের আন্দোলন

ড. আকমল হোসেন |

গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু থেকে প্রাথমিক স্কুল, কলেজ, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, এমপিওভুক্ত স্কুুলের শিক্ষকরা তাদের মর্যাদা, বেতন এবং প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার দাবিতে আন্দোলন করছেন। প্রথমে প্রাথমিক স্কুল পর্যায়ের সহকারী শিক্ষকরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের বেতন স্কেল বৈষম্য নিরসনের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান করা শুরু করেছিলেন, যা পরে অনশনে রূপ লাভ করেছিল। সংশ্নিষ্ট মন্ত্রীর আশ্বাসের পর তারা তাদের আন্দোলনের ইতি টানেন। এর পরপরই এমপিওভুক্ত নন এমন শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের জন্য এ সুযোগ দাবি করে প্রেস ক্লাবের সামনে প্রথমে অবস্থান ও পরে অনশন শুরু করেন। তাদেরও আশ্বাস দেওয়া হলে তারা বাড়ি ফিরে যান।

এরপর শুরু হয় ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতনের দাবিতে আন্দোলন। চাকরি জীবনে সরকারি সূত্রে তারা কোনো ধরনের বেতন না পেয়ে অন্যদের মতো প্রথমে প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান ও পরে অনশন করে দাবি পূরণে আশ্বাস আদায় করেন। সবশেষ আন্দোলনে আসেন সেসব শিক্ষক, যারা ইতিমধ্যে এমপিওভুক্ত; কিন্তু এবার তারা দাবি তুলেছেন তাদের চাকরি জাতীয়করণ করার। এসব শিক্ষক আন্দোলন শুরুর আগে গত বছর উপজেলা পর্যায়ে জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকরা নিজেদের ক্যাডারভুক্তির দাবি তুলেছিলেন, যা বিরোধিতা করেছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষকরা।

দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন সরকারের শেষ সময়ে শিক্ষকদের আন্দোলন করা অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনরাও চান না এত বড় এক গোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট রেখে ভোটযুদ্ধ যাওয়ার ঝুঁকি নিতে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষকদের আন্দোলনে বেতন ও ভাতা সংশ্নিষ্ট বিষয় প্রাধান্য থাকে, যা স্বাভাবিক। কিন্তু বেতন-ভাতা নিয়ে কোনো একটা সমাধানে এলে পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা বা জাতীয়করণ করার পর ক্যাডারভুক্তির দাবি করা আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে। এ রকম ধাপে ধাপে আন্দোলন করা যেমন দাবি পূরণে সরকারের উদাসীনতার স্বাক্ষর আবার কোনটা ন্যায্য, কোনটা অন্যায্য দাবি সে সম্পর্কে শিক্ষকদের অসচেতনতার লক্ষণও। বিশেষ করে মান নির্বিশেষে সব স্কুুল-কলেজ এমপিওভুক্ত করা বা জাতীয়করণ করার পর ক্যাডারভুক্তির দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, অনৈতিকও বটে।

দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, যার অধিকাংশ বেসরকারি পর্যায়ে হয়েছে। ব্রিটিশ-পাকিস্তান যুগে বেসরকারি বিদ্যোৎসাহী বিত্তশালী ব্যক্তিদের আনুকূল্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু হয়েছিল। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাই রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বরাবরই কম ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে, সংখ্যার বিচারে সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশি। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পেছনে এখন বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির তুলনায় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ভূমিকা বেশি দেখা যায়। রাজনীতিবিদরা নিজের নামে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান শুরু করতে পিছিয়ে থাকেন না। জীবিত ব্যক্তির নামে স্কুল স্থাপন এখন স্বাভাবিক ব্যাপার, যা ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমলে শোনা গেছে বলে মনে হয় না।

এর সঙ্গে দলীয় সর্বোচ্চ নেতা বা তার আত্মীয়-স্বজনের নামেও তারা স্কুল-কলেজ করে তাদের রাজনৈতিক আনুগত্য দেখাতে চান। তাদের এসব উদ্যোগ শিক্ষা বিস্তার না বলে আত্মপ্রচার বা রাজনৈতিক সুবিধার লক্ষ্যে পরিচালিত বলা যায়। অন্যদিকে রয়েছে ব্যবসা হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান শুরু করার প্রবণতা। স্বাধীন দেশে ব্যবসার নানা ফিকিরের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নতুনত্ব দান করেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় এটা বেশি লক্ষণীয়। বর্তমানে দেশে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ট্রাস্টের নামে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করছে। বাদবাকি প্রতিষ্ঠাতারা পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এখান থেকে লাভ-ক্ষতির দিকে তীক্ষষ্ট নজর রাখেন।

বেসরকারি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে শিক্ষা বিস্তারের তুলনায় রাজনৈতিক বা ব্যবসার লক্ষ্য থাকে বলে এগুলো কোনো পরিকল্পনামাফিক শুরু করা হয় না। ভৌগোলিক দূরত্ব না বিবেচনা করে স্কুল-কলেজ করার ফলে সবাই পর্যাপ্তসংখক শিক্ষার্থীও পায় না। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানেও ঘাটতি থাকে। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব প্রকট থাকে যেমন, তেমনি শিক্ষাগত যোগ্যতায় উত্তীর্ণ শিক্ষকদেরও অভাব থাকে। যেসব শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়, তারা অর্থের বিনিময়ে বা প্রতিষ্ঠাতার আত্মীয় হওয়ার ফলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সবাই শিক্ষক হওয়ার জন্য শিক্ষকতা পেশায় আসেন না। বরং অন্য কোনো চাকরি না পেলে শেষ পর্যন্ত এ পেশা বেছে নেন, এমনও দেখা যায়। এসব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা এসবে নিয়োজিত শিক্ষকদের মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থাকতে পারে।

মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম প্রধান চাহিদা হওয়ায় এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করার কিছু নেই। বার্ষিক জাতীয় বাজেটে শিক্ষাকে বরাবর প্রস্তাবিত মোট বরাদ্দের মধ্যে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেমন- ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাতে বাজেটের ১৫.৫ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬.৪ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারপরও রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর তাগিদ থেকে যায়। শিক্ষালাভ করা বিষয়টি মানুষের জন্য সুযোগ নয় বরং অধিকার হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না বলে শিক্ষা আর দশটা পণ্যের মতো বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। বাজারে সবচেয়ে মহার্ঘ পণ্য কেনার সবার সামর্থ্য নেই বলে কম মূল্যের মানহীন পণ্য কেনার মতো মানহীন শিক্ষালাভ করতে দেখা যায়। মানসম্মত বেতন না পেয়ে একজন শিক্ষক কতদূর মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারেন, তা ভাবা দরকার।

শিক্ষকদের আন্দোলনের দাবি-দাওয়াগুলো পরীক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে যে প্রায় সব বেতন-ভাতা সংক্রান্ত। বরাবরের মতো শিক্ষকরা এবারও একই কৌশল ব্যবহার করে সরকারের আশ্বাস পেয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসা শিক্ষকদের বারবার একই প্যাটার্নে অবস্থান, অনশন, সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে ঘরে ফিরে যেতে হচ্ছে। এটা তাদের জন্য যেমন মর্যাদাকর নয়, তেমনি এ গোষ্ঠীর প্রতি শাসকদের অবহেলা-উপেক্ষার নজির। শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে সহানুভূতি থেকে সমালোচনা তৈরি হলে সরকারের টনক নড়ে। শিক্ষকদের যে অংশটি আন্দোলন করছেন, তারা শিক্ষক সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও নিম্ন মর্যাদার শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সাম্প্রতিক অতীতে আমলাদের সমান বেতন দাবিতে যখন আন্দোলন করেছিলেন, তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসেছিলেন।

কিন্তু এ পর্যায়ের শিক্ষকরাই তো দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ভিত তৈরি করার কাজে নিয়োজিত। তাদের প্রতি সুদৃষ্টি দেখানো শিক্ষাক্ষেত্রে সুবিনিয়োগের সূত্রপাত বলে বিবেচিত হবে। অথচ এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো সুচিন্তিত নীতি বা কর্মপরিকল্পনা নেই। আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে যা করা হয় তাকে অ্যাডহক পদক্ষেপ বলে ধরা যেতে পারে।

এ পর্যায়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা-এমপিওভুক্তি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য কোনো নীতিমালা না থাকায় সরকারি পদক্ষেপে সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান বেরিয়ে আসে না। অথচ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান ছাড়াও এসব শিক্ষককে সরকারের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। জাতীয় নির্বাচনে এদের ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালন, সরকারের কোনো কোনো জরিপ কাজে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে তাদের সম্পৃক্ত হতে হয়।

স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা অনুমোদন দেওয়া, তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নির্ধারণ, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মানদণ্ড এ নীতিমালার অধীনে থাকতে হবে। তবে ঢালাওভাবে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমোদন না দেওয়ার নীতি যেমন দরকার, তেমনি যোগ্যতা নির্বিশেষে সবাইকে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কঠোরতা দেখানো দরকার।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042791366577148